প্রফেসর ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন:
বাংলাদেশকে তথা বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন ছিল তিনটি। এক, স্বাধীন-সার্বভৌম বাঙালি জাতি রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা; দুই, বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের জনগণের নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠা; তিন, বাংলাদেশকে তথা বাংলাদেশের জনগণকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। প্রথম দুটি তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার জীবদ্দশায় তার নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা এবং তার রাজনৈতিক দর্শনের নির্দেশনায় সংবিধান প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। তৃতীয়টি তিনি শুরু করেছিলেন সদ্য স্বাধীন, যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করে। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণের আগেই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে তথা বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার সেই স্বপ্নপূরণে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে পদার্পণ করেন, যে দিনটি ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে উল্লিখিত। এ কথা অবধারিত যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ণতা পেয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ পেয়েছে মূলত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে। ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ এই কারণে আমাদের জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আরো একটি বিষয়কে নির্দেশ করে। তা হলো, এই ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু এক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনসহ নানা নির্দেশনা সংবলিত দার্শনিক ভাবধারা উপস্থাপন করেন, যা ছিল তার আজীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর চেতনার দার্শনিক মূল্যবোধের প্রতিফলন।
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেই যে আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। তার ভাষণের একাংশে বলেন, ‘কবিগুরু…আমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ এই বক্তব্য বাঙালি জাতির জন্য দর্শন সংবলিত এক অভাবনীয় বক্তব্য। বক্তব্যটি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায়, মানুষ অর্থে প্রকৃত মানুষ, যে মানুষ অধিকারসচেতন, যে মানুষ অসাম্প্রদায়িক, যে মানুষ বিজ্ঞানমনস্ক, যে মানুষ প্রগতিশীল, যে মানুষ সাহসী, সংগ্রামী এবং মানবিক মন ও মননে আপসহীন মানুষ। এই মানুষই সব ক্ষমতার উত্স। যেমনটি বঙ্গবন্ধু মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, জনগণই সব ক্ষমতার উত্স। প্রসঙ্গক্রমে এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ‘ব্রেইনচাইল্ড’ ৬ দফা প্রদানের মধ্য দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ফলে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ওপর আস্থা অর্জন করেছিল। ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুও সমগ্র বাঙালির প্রতি আস্থা এনেছিলেন, যার ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করা আর ’৭০-এর নির্বাচনে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায়। বঙ্গবন্ধু জনগণের ওপর আস্থা এনে মহান মুক্তিযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে। নেতার প্রতি জনগণের আস্থা আর জনগণের প্রতি নেতার আস্থা অর্জনে প্রমাণিত হয়েছে, বিভন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহে, যেমন :’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ’৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা ঘোষণা’, ’৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা, এবং ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয়লাভ, ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ, পরে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও কার্যকর করার মধ্য দিয়ে।
প্রাসঙ্গিকভাবে এ কথা বলা প্রয়োজন যে, বর্তমানে বাংলাদেশ সমন্বিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্পায়ন, সড়কযোগাযোগ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী সম্প্রসারণ, শিক্ষাব্যবস্থায় অমূল পরিবর্তনসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্থানীয় ও তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা, আবাসনসহ প্রায় প্রতিটি খাতভিত্তিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি এখন দৃশ্যমান। এই অগ্রগতি চলমান ও গতিশীল করতে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশের জনগণের যথাযথ অবদান নিশ্চিত করা। এই অবদান নিশ্চিত করতেই উল্লিখিত সঠিক ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের জনগণের মন ও মননে সঞ্চারিত করতে হবে; যার মাধ্যমে পরিচয় ঘটবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, উন্নয়ন দর্শন, শিক্ষা দর্শনসহ সমন্বিত দার্শনিক মূল্যবোধের, যা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত করতে অতীব গুরুত্ববহ। আর তাহলেই এই দেশ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন প্রকৃত আদর্শবান দেশপ্রেমিক মানুষ। যে মানুষের কথা বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২-এ। যে কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ইতিহাসের আলোকে গুরুত্ববহ ও তাত্পর্যপূর্ণ। স্বাধীনতার ৫২ বছর পার করছে বাংলাদেশের জনগণ। এই বাংলাদেশের সমগ্র জনসাধারণের একটি বড় অংশ তরুণ প্রজন্ম। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। এছাড়া যুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে ভুল তথ্য ষড়যন্ত্রমূলকভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা বিদ্যমান ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব এবং মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর সঠিক ইতিহাস ও ঘটনাবলি বাংলাদেশের জনগণ যখন সঠিকভাবে আহরিত করবে, তখন বর্তমান বাংলাদেশের জনগণ এবং তরুণ প্রজন্ম নিজেরাই নিজ বিবেচনাপ্রসুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে এবং আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে কর্মোদ্যোগী হবে, যার মাধ্যমে গড়ে উঠবে ত্যাগের মহিমা, উদ্বুদ্ধ হবে দেশপ্রেমের আবর্তে দেশ গড়ায় এবং নিজেদের আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করায়, যা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্নগুলোর একটি।
লেখক: সাবেক উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; প্রফেসর, সমাজকর্ম বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার