Daily Jalalabadi

  সিলেট     শুক্রবার, ১৫ই নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩০শে কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: কলেজে উচ্চশিক্ষার অবস্থা ‘শোচনীয়’

admin

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়: কলেজে উচ্চশিক্ষার অবস্থা ‘শোচনীয়’

স্টাফ রিপোর্টার:
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সিলেটের এমসি কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স বা স্নাতক (সম্মান) চালু হয় ২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষে। একই বিভাগে স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স চালু হয় ২০১১ সালে।

শতবর্ষী এই কলেজে ডিগ্রি (পাস কোর্স) ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিও রয়েছে। ডিগ্রি এবং উচ্চমাধ্যমিকে পরিসংখ্যান পড়ার সুযোগ আছে। কিন্তু কলেজটিতে পরিসংখ্যান বিভাগে শিক্ষকের পদ মাত্র চারটি। তবে আট মাস ধরে কর্মরত আছেন শুধু একজন।

এমসি কলেজে পরিসংখ্যান বিভাগে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য আসন রয়েছে ১৩০টি। এখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে পড়ছেন প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষার্থী। মাত্র একজন শিক্ষকের পক্ষে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যে সম্ভব নয়, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার ওই শিক্ষককেই ডিগ্রি এবং উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিরও পাঠদান করতে হয়।

এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে একাডেমিক মহাপরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। যেখানে একজন শিক্ষার্থী সময়মতো শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা শেষে হল থেকে বের হয়ে প্রশ্নপত্র দেখছেন পরীক্ষার্থী।
এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে পরিসংখ্যান বিভাগের প্রাক্তন দুই শিক্ষার্থীকে ‘অতিথি শিক্ষক’ করা হয়েছিল। তাঁদের মাসে ৫ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হতো। তবে গত মাসে তাঁদের একজন অন্য চাকরি পেয়ে চলে গেছেন।

এমসি কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ১৫ হাজার। এই কলেজে গড়ে ১২৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক আছেন মাত্র ১ জন। শুধু এমসি কলেজই নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বেশির ভাগ কলেজে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়াশোনা চলছে ‘কোনোরকমে’। শিক্ষক, অবকাঠামো ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণে ও ব্যবসায়িক মানসিকতা থেকে ঢালাওভাবে চালু করা হয়েছে স্নাতক (সম্মান) কোর্স। এখন দেশের সরকারি-বেসরকারি ৮৮০টি কলেজে অনার্সই চালু রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ সরকারি কলেজ।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর গড় অনুপাত ১: ১৯। অর্থাৎ প্রতি ১৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক রয়েছেন। অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য গড়ে শিক্ষক রয়েছেন ১ জন। বাছাই পরীক্ষা ছাড়াই অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে কলেজগুলোতে ভর্তির কারণে শিক্ষার্থী ও কলেজ উভয় দিকেই কয়েক ধরনের সমস্যা হয়। বেশির ভাগ কলেজে নেই পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার। এসবের ফলে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছেন না। আবার মূল্যায়নব্যবস্থাও দুর্বল। উত্তরপত্র মূল্যায়ন একক পরীক্ষকনির্ভর। এর ফল হচ্ছে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী এসব কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রি নিলেও বেকার থাকছেন। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০২১ সালের এক জরিপের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন।

শিক্ষক এবং অবকাঠামো বাড়ানোর ক্ষমতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। আবার কলেজগুলো বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বছরের পর বছর ভর্তি করে এলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অনেকটাই নীরব।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে এখন শিক্ষার্থী রয়েছেন ২৯ লাখের বেশি। বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষায় যত শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন, তার মধ্যে ৬৬ শতাংশই পড়েন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে। এখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের। এর বাইরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী আছেন প্রায় সাড়ে ৬ লাখ।

১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কলেজের উচ্চশিক্ষা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে। এখন স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি দেওয়া হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আছে পেশাগত কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এর কার্যক্রম শিক্ষা বোর্ডের মতো। বড় কাজ মূলত পরীক্ষা নেওয়া। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি কাঙ্ক্ষিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা থাকার কথা অস্বীকার করেননি উপাচার্য মশিউর রহমান। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে একাডেমিক মহাপরিকল্পনা করেছেন তাঁরা। যেখানে একজন শিক্ষার্থী সময়মতো শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবেন। একই সঙ্গে নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন।

তবে একাডেমিক মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা সবচেয়ে বেশি জরুরি বলে মনে করেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর। তিনি বলেন, শিক্ষক এবং অবকাঠামো বাড়ানোর ক্ষমতা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। আবার কলেজগুলো বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বছরের পর বছর ভর্তি করে এলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অনেকটাই নীরব। এ অবস্থায় তাদের মহাপরিকল্পনা কতটা বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন আছে।

উচ্চশিক্ষায় গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে গবেষণা নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২২ সালের) অনুযায়ী, ২০২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৫ কোটি টাকা। তবে ওই বছরে কোনো গবেষণা হয়েছে কি না, তা জানা যায়নি। এর কারণ, কোনো প্রকাশনা বের করতে পারেনি তারা।

অন্যদিকে কলেজগুলোর শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক ব্যয়ও অনেক কম। ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় ছিল মাত্র ৭৪৩ টাকা। অথচ অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় অনেক বেশি। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি বার্ষিক ব্যয় ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা। একই বছরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় ছিল ২ লাখ ৯৮ হাজার ৬৬০ টাকা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে যা ছিল ৪৪ হাজার টাকা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমের সমস্যা দূর করতে বড় কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে দেওয়া ওই নির্দেশনা প্রায় তিন বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল। কলেজগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

এই সাত কলেজের পাঠদান করেন সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর শিক্ষকেরাই। তবে পাঠ্যসূচি ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের কাজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে হয়। অবশ্য পরীক্ষাপত্রের মূল্যায়নের কাজটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কলেজের শিক্ষকেরা মিলে করেন।

তবে বাকি আরও কিছু কলেজকে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার প্রক্রিয়াটি থেমে আছে।

ময়মনসিংহে অবস্থিত আনন্দ মোহন কলেজে শিক্ষার্থী এখন ৩০ হাজারের বেশি। শিক্ষক আছেন ২২০ জন। এই হিসাব বলছে, গড়ে ১৩৬ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১ জন শিক্ষক আছেন। আবার কলেজটিতে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ঢাকার একটি কলেজের অর্থনীতির একজন শিক্ষক বলেন, বড় কলেজগুলোতে স্নাতকে (সম্মান) একেকটি শ্রেণিতে ২০০ থেকে ৩০০ বা তারও বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। কিন্তু কোনো কলেজেই এত শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে পড়ানোর মতো শ্রেণিকক্ষ নেই। ফলে যে শিক্ষার্থীটি পেছনে বসেন, তিনি শিক্ষকের কথা শুনতে পারেন না। এ রকম পরিস্থিতিতে অনেকেই মনোযোগ হারিয়ে ক্লাসবিমুখ হয়ে পড়ে।

চট্টগ্রাম কলেজের গণিত বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তাঁদের বিভাগে অনার্সের পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালে। কিন্তু হয়েছে ২০২১ সালে। মাস্টার্সেও তেমন ক্লাস পাননি।

এ রকম পরিস্থিতিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আট বছর মেয়াদি (২০২৩-৩১) মহাপরিকল্পনা করেছে। তাতে স্নাতক ডিগ্রি কোর্সকে পুনর্গঠন, উচ্চশিক্ষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিশিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া, বাজারমুখী স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কোর্স চালু করা, বাজারের সঙ্গে মিল রেখে ইন্টার্নশিপ চালু করাসহ বেশ কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে পরীক্ষা ও মূল্যায়নব্যবস্থাও সংশোধনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, সার্বিকভাবে কলেজগুলোর অবস্থা শোচনীয়। যথেষ্টসংখ্যক শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাবরেটরি ছাড়া ঢালাওভাবে অনার্স-মাস্টার্স থাকা উচিত নয়। এতে উচ্চশিক্ষার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

 

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 999 বার

শেয়ার করুন