স্টাফ রিপোর্টার:
কোনো ‘দুরভিসন্ধি’ ছাড়া মন্ত্রীরা একের পর এক বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার রাজনীতি করা না করার প্রশ্নে কথা বলছেন, সেটা বিশ্বাস করছে না বিএনপি। সে জন্য দলটি বিষয়টাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে সরকারের উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে।
এখন সরকারের কৌশল বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে বিএনপিকে। দলটি অবশ্য বিষয়টাতে নিজেদের সতর্ক থাকার কথা বলছে।
যদিও কোনো দুরভিসন্ধি থাকার অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে মন্ত্রীদের কথাবার্তা বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিজেদের মধ্যেই বিভ্রান্তি বা সন্দেহ সৃষ্টি করতে পারে। এটিই ক্ষমতাসীনদের কৌশলের একটা অংশ হতে পারে।
অন্তত চারজন মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন গত কয়েক দিনে। তাঁদের মধ্যে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য একই রকম। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, খালেদা জিয়ার মুক্ত থাকার শর্তে যা আছে, তাতে তাঁর রাজনীতি করতে বাধা নেই।
কিন্তু সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ—এই তিনজন মনে করেন, সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্ত থাকায় খালেদা জিয়া রাজনীতি করতে পারবেন না।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেত্রীর রাজনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের এই মন্ত্রীরা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়ে এই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
তাঁদের বক্তব্যকে স্ববিরোধী বলে বর্ণনা করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তাঁদের নেত্রী রাজনৈতিক কারণে জেলে গেছেন এবং এখন বাসায় থাকলেও কার্যত কারাবন্দী রয়েছেন। ফলে খালেদা জিয়া রাজনীতিতে আছেন বলেই তাঁরা মনে করেন। কিন্তু তাঁর রাজনীতি করতে পারা না পারা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পেছনে সরকারের মতলব কী থাকতে পারে, সেটা বিএনপি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
তবে আওয়ামী লীগের একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতার সঙ্গে কথা বলে এটা মনে হয়েছে যে প্রশ্নটি তুলে এই বিতর্ক সৃষ্টি করাই তাঁদের কৌশলের একটা অংশ।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনীতির বিষয়টি হঠাৎ করেই গত জানুয়ারি মাসে সামনে নিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম। গত ২৬ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে তিনি দাবি করেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতি করবেন না, এমন মুচলেকা রয়েছে। তখন বিএনপি তাঁর এ বক্তব্য সত্য নয় বলে জানিয়েছিল। শেখ সেলিমও তাঁর দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি।
এখন কয়েক দিন ধরে যে বিতর্ক চলছে, এর সূত্রপাত করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি যদিও খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে তাঁর বক্তব্যের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য, কৌশল বা সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে দাবি করছেন। তিনি বলতে চাচ্ছেন, তিনি কেবল সাংবাদিকের প্রশ্নে আইনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি তাঁর প্রথম দিনের বক্তব্যেই থেমে থাকেনি। এরপর আরও তিনজন মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা বক্তব্য দিয়েছেন ওই একই ইস্যুতে। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য আসায় আবারও আইনমন্ত্রীকে তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কথা বলতে দেখা গেছে।
ভিন্ন ভিন্ন কথা হলেও মন্ত্রীরা যে একের পর এক খালেদা জিয়ার রাজনীতির বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, এর পেছনে কোনো কৌশল নেই—সেটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
যদিও সরকারের উদ্দেশ্য বুঝতে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বকে। কিন্তু মন্ত্রীদের বক্তব্য নিয়ে দলটিতে চলছে নানা আলোচনা। দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন, সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের আন্দোলন এবং নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীনেরা খালেদা জিয়াকে ‘কার্ড’ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারেন। আর সে ক্ষেত্রে তাঁরা মন্ত্রীদের বক্তব্যকে একটা ফাঁদ হিসেবে দেখছেন।
খালেদা জিয়া প্রায় তিন বছর ধরে জেলের বাইরে বাসায় থাকছেন। তিনি রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি।
দলটির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া তাঁর অসুস্থতা এবং বয়সের কারণে দলের নেতৃত্বে সক্রিয় হবেন না—এটি বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা । সেখানে তাঁর ছেলে তারেক রহমান বিদেশে থেকেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন দলের তৃণমূলে। যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও এখন তাঁর হাতের মুঠোয়। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে যাঁরা তারেক রহমানের নেতৃত্ব পছন্দ করতেন না, তাঁদেরও এখন তাঁকে মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
তারেক রহমানের নেতৃত্বেই বিএনপি এবার শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার অবস্থানে অটল থেকে তাদের যুগপৎ আন্দোলনের একটা পরিণতি দেখতে চাইছে। এর কোনো এক পর্যায়ে দলের কোনো অংশ যদি খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের করে অন্তত গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয় পর্যন্ত আনতে পারে, তাতে ওই আন্দোলনে নেতা-কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ সৃষ্টি হবে।
কিন্তু এভাবে খালেদা জিয়াকে রাজপথে আনা হলে তাঁকে আবার জেলে পাঠানো এবং আন্দোলন দমনে সরকারের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তখন আন্দোলনকে সহিংসতায় ঠেলে দেওয়ার কাজও সরকারের জন্য সহজ হবে। এ ছাড়া তারেক রহমানের নেতৃত্বও তখন দলের ভেতরেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকেই এ ধরনের কোনো ফাঁদ পাতার কৌশল নিয়ে মন্ত্রীরা এখন খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন বলে বিএনপির নেতাদের অনেকে মনে করেন।
বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ আবার মনে করেন, তাঁদের দলকে নির্বাচনে আনার জন্য আলোচনার উদ্যোগ নিয়ে সরকার খালেদা জিয়ার ইস্যুকে ব্যবহার করতে পারে।
এ ধরনের নানা আলোচনা থেকে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় অংশই সরকারের ফাঁদে পা না দেওয়ার কথাই বলছেন। তবে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির ওপর তাঁদের নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকবে—সেটা এখনই বলা মুশকিল।
অন্যদিকে আগামী নির্বাচন এবং বিএনপির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার বড় ধরনের সংকটে পড়লে তখন খালেদা জিয়ার বিষয়কেই ক্ষমতাসীনেরা ব্যবহার করতে চাইবেন। ক্ষমতাসীন দলের জ্যেষ্ঠ একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
সে জন্য সরকার খালেদা জিয়ার রাজনীতির বিষয়টি আগাম তুলে রাখল।
তবে বিষয়টিতে মন্ত্রীদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করেন সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, আইনগতভাবে বিএনপির নেত্রীর রাজনীতি করার সুযোগ থাকলে বিতর্ক না করে তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত।
আইনি ব্যাখ্যাতেও ভিন্ন ভিন্ন মত
অন্যতম একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রবীর নিয়োগী বলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২ উপধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তির নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে দুই বছরের কারাদণ্ড হলে, সেই ব্যক্তি মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এই বিধান অনুযায়ী খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন না। কিন্তু খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে আইনগত কোনো বাধা নেই বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন আইনজীবী এবং আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তিনি বলেন, সাজা স্থগিত করে বিএনপির নেত্রীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে; ফলে তিনি রাজনীতি করতে পারবেন না।
তবে লেখক ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির বিষয়টি বিএনপিকে ফাঁদে ফেলার জন্য সরকারের নতুন কোনো রাজনৈতিক কৌশলের অংশ।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার