প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী:
বিশ্ব আজ অশান্ত হয়ে উঠেছে। সরবরাহজনিত সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে বিশ্বনেতৃবৃন্দের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের অভাবে। বৈশ্বিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি এবং সামষ্টিক চাহিদা, সামষ্টিক জোগান ও বিভিন্ন দেশের বহিঃস্থ খাতসমূহের মধ্যে দেখা দিচ্ছে ভারসাম্যহীনতা। ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠী লোহিতসাগরে বাণিজ্যবাহী জাহাজে আক্রমণ করার দরুন এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিবেশ গত নভেম্বর থেকেই প্রতিকূল। এর নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের ন্যায় উন্নয়নশীল দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হচ্ছে। বিশেষত বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব অনুভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হুতিদের এ ধরনের অপতত্পরতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বমহলে।
উপরিউক্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানসমূহকে কলাকৌশল ঠিক করতে হবে কীভাবে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করা যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো বিদ্যমান এবং ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালাচ্ছে। একদিকে মানবিক বিপর্যয় বিদ্যমান যুদ্ধরত স্থানগুলোতে, অন্যদিকে অন্যান্য দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং পণ্য বাজারজাতকরণে কৃত্রিম সংকট ও ওলিগোপলিস্টিক উপায়ে সিন্ডিকেট তৈরির ফলে দেশে দেশে অর্থনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। লোহিতসাগর ব্যবহার না করে বিকল্প ট্রান্সপোর্টেশান ব্যবস্থায় পণ্য পরিবহনের কারণে দূরত্ব বিবেচনায় পণ্যের দামও বেড়ে যাচ্ছে। তাই বিশ্ব অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় বৈশ্বিক শান্তি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কূটবিতর্কে না গিয়ে বলতে পারি, বিশ্বব্যাপী গুটিকয়েক মোড়লের ক্ষমতা প্রদর্শন ও আধিপত্য বিস্তারের কারণে তার মাশুল গুনতে হচ্ছে সারা বিশ্ববাসীকে। তারা সমগ্র বিশ্বে যে ধরনের অশান্তি সৃষ্টি করছেন, তার থেকে তাদের নিজস্ব দেশও সমূহ ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। অর্থাত্ অন্যের ঘরে আগুন লাগালে তার আঁচ নিজ ঘরেও পড়বে না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশের প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয় জলপথে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে আমাদের প্রায় ৭০ শতাংশ রপ্তানি হয় আলোচ্য সংঘাতমুখর লোহিতসাগরে। আর রাশিয়া, ইউক্রেন, রোমানিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, ডাল, সয়াবিন প্রভৃতি পণ্য আমরা আমদানি করি এই রুটে। তার মানে রেড সি ক্রাইসিস আমাদের জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এই কারণে আফ্রিকা হয়ে ভিন্ন পথে আমদানি-রপ্তানি করলে আগের চেয়ে অন্তত ১০ দিন বেশি সময় লাগবে। এতে জাহাজ ভাড়াসহ পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিমধ্যে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। তবে আমরা আশা করতে পারি, বাংলাদেশের পণ্যবাহী জাহাজ হুতিদের আক্রমণের টার্গেট হবে না। যেহেতু তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত জাহাজ। তার পরও ঝুঁকি রয়েছে এবং শিপমেন্টের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলো এই ঝুঁকি গ্রহণ করতে চাইবে না। অন্যদিকে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল প্রভৃতি দেশ থেকে আমরা পণ্য আমদানি করি, রেড সি ক্রাইসিসির কারণে তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। অর্থাত্ আমাদের আমদানিকৃত পণ্যের নগণ্য অংশ লোহিতসাগর দিয়ে আসে বলে আমদানি বাণিজ্য তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তবে পোশাক রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে আমাদের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান, লোহিতসাগরের অস্থিরতা অচিরেই নিরসন হচ্ছে না।
এদিকে মিয়ানমার থেকে তাদের দেশের অধিবাসীদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার ফলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। তারা বাংলাদেশের পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। তাদের কারণে স্থানীয় মানুষের শ্রমের মজুরি হ্রাস পাচ্ছে এবং সর্বোপরি স্থানীয় জনসাধারণ সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি অবাধ মাদকের কারবারের কারণে বাংলাদেশের যুবক-যুবতিদের নষ্ট করার প্রয়াস যেন নিয়েছে প্রতিবেশী এই দেশটি। এক্ষণে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিজেরাই বিদ্রোহের দাবানলে জ্বলছে। আগেই বলেছি, ‘অন্যের ঘরে আগুন লাগালে, রাজনৈতিক অর্থনীতি সাক্ষ্য দেয় যে, নিজের ঘরে পুড়তে সময় লাগে না।’
আশা করা যায়, বর্তমান অর্থমন্ত্রী ও অর্থ উপদেষ্টার সম্মিলিত নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো আবার জোরালোভাবে ঊর্ধ্বমুখী হবে। কেননা অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে বাণিজ্য চক্র কখনো ওপরে যাবে, আবার নিচে আসবে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে আন্তর্জাতিক মূল্যস্ফীতি এ দেশের মূল্যস্ফীতিকেও আঘাত করেছে। আশা করি, মূল্যস্ফীতি এ বছরের শেষ লগ্নে ৬ শতাংশে হ্রাস পাবে। মুদ্রানীতি যেটি ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বেসরকারি খাতের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রয়াস কমে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব মানুষের জন্য পেটে ভাতের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দর্শনের সঙ্গে বর্তমান ঘোষিত মুদ্রানীতি সাংঘর্ষিক। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, আমদানি বিকল্পায়ন শিল্পব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাস্তবায়নে লাগসই প্রযুক্তির ব্যবহার জোরদার করতে হবে। যারা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংযুক্ত, তাদের যেন সুশাসনের (Good Governance) স্বার্থে জবাদিহির আওতায় আনা যায়।
প্রাথমিক স্বাস্থ্য খাতে সরকার গত পনেরো বছরে অনেক অর্জন করেছেন। কিন্তু ক্রিটিক্যাল চিকিত্সা খাতে একশ্রেণির বেনিয়া ও মাফিয়া চক্র বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নামে-বেনামে অতিরিক্ত ফি আদায় করে চলেছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কেননা জনগণের স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে জাতীয় অর্থনীতির উন্নতি হবে না। একটি দেশে যখন উন্নয়ন হয়, তখন অনেকেই নানা উপায়ে বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনার অপপ্রয়াস পান। এক্ষণে ব্যাংকিং সেক্টরে অবশ্যই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যবস্থাগ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরির জন্য ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন আনতে হবে। শ্রমবাজার নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যাতে করে বিদেশে শ্রমজীবী মানুষরা গেলে তারা যথানিয়মে বৈধ চ্যানেলে অর্থ দেশে পাঠাতে পারেন। এজন্য বিদেশস্থ শ্রমজীবীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহে আমাদের দেশের ব্যাংকসমূহকে ইনোভেটিভ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। কেননা বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা ছুটি ঠিকমত না-ও পেতে পারেন। বরং হুন্ডি ব্যবসায়ীরা যেভাবে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন আমাদের দেশের ব্যাংকের কর্মকর্তারা সেভাবে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে পারেন।
এদিকে দেশের ভেতরে ব্যাংকিং চ্যানেলে উঠোন বৈঠক পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করে ঋণ আদায়কে শক্তিশালী করার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। মার্কিন ডলার-সংকটের সমাধান নিয়েও গভীরভাবে ভাবতে হবে। সরকারের জরুরি আমদানির জন্য পৃথক ফান্ড গঠন করা যেতে পারে, যেমন—জ্বালানি তেল। এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটায় সংরক্ষণের পরিমাণ আগামী এক বছরের জন্য ৫ শতাংশে কমিয়ে আনা দরকার এবং ম্যানেজড স্পোটিং এক্সচেঞ্জ রেইট বজায় রাখা উচিত। পাশাপাশি একটি ট্রুথ কমিশন গঠন করে বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নতুন পোশাক তৈরি ব্যবস্থা, বাজারজাতকরণ ও বিপণনের মাধ্যমে অধিকতর রপ্তানিলব্ধ আয় সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংকিং কাঠামোয় মানবসম্পদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আবশ্যক যেখানে সততা, জবাবদিহিতা ও তৃণমূল থেকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পরিচালকমণ্ডলী গড়ে তোলা দরকার। এভাবে ব্যাস্টিক অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করতে হবে।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আশা করি, আগে থেকেই কলাকৌশল তৈরি করে কৃষির ওপর অধিকতর জোর দিতে হবে। কর্মসংস্থানের জন্য কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র এবং ছোট প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তুলতে হবে। অর্থায়ন ও মার্কেটিং পদ্ধতি সুষ্ঠু করতে হবে। সর্বোপরি পুঁজি বাজারকে ঢেলে সাজাতে শেয়ার মার্কেটের পাশাপাশি ডেবিট মার্কেট ও ডেরিভেটিভ মার্কেট প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বৈশ্বিক তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দেশের অর্থনীতিতে যাতে চাপ না পড়ে, সেজন্য দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে। দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি বাড়ানোর কাজ আরো এগিয়ে নিতে হবে। আশা করি, নতুন সরকার দেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, আইটি বিশেষজ্ঞ ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার