স্পোর্টস ডেস্ক:
আর্জেন্টিনায় তাকে ডাকা হয় না ‘এল দিয়াবলিতো’ নামে। স্প্যানিশ এই শব্দের অর্থ হলো ‘ছোট শয়তান’। বল পায়ে ক্ষীপ্রতা ও প্রতিপক্ষের রক্ষণে ঝড় তোলার ক্ষমতার জন্য তার এই নাম। কী ভাবছেন, তিনি ফরোয়ার্ড কিংবা স্ট্রাইকার? ভুল ভাবছেন। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের ভূমিকায় সবসময় খেলেন, তবে প্রয়োজনে লেফট উইং ধরেও আক্রমণে গতি বাড়াতে পারেন। ঠিক যেমনটা লিওনেল মেসি। সেকারণে তাকে ডাকা হয় আর্জেন্টিনার ‘নতুন মেসি’ নামেও।
এত সব বিশেষণের মাঝে তার আসল নামটাই তো বলা হলো না। তিনি ক্লাউদিও এচেভেরি। ম্যানচেস্টার সিটির নতুন সদস্য। আর্জেন্টাইন ক্লাব রিভার প্লেট থেকে সাড়ে চার বছরের চুক্তিতে ইংলিশ ক্লাবে নাম লিখিয়েছেন এই আর্জেন্টাইন। বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল ও পায়ের কারুকাজে বেশ কিছুদিন ধরেই ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর চাহিদার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তবে তাকে পাওয়ার দৌড়ে জয়ী ম্যান সিটি।
ইংলিশ চ্যাম্পিয়নরা নিশ্চিত করেছে, ১৪.৬০ মিলিয়ন ইউরোতে আর্জেন্টাইন মিডফিল্ডার এখন তাদের। অবশ্য এখনই সিটির জার্সিতে খেলা হচ্ছে না। চুক্তি সম্পন্ন করলেও আপাতত ধারে খেলা চালিয়ে যাবেন শৈশবের ক্লাব রিভার প্লেটে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেবেন ইত্তিহাদ স্টেডিয়ামে।
এ মাসের শুরুতে ছিল এচেভেরির ১৮তম জন্মদিন। রিভার প্লেটে আলো ছড়িয়ে নাম লেখালেন ইউরোপিয়ান ফুটবলে। তবে আরও আগে থেকেই নিজের নাম ফুটবল বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। সেটা সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে!
২০১৭ সালের দিকের ঘটনা। এচেভেরির বয়স তখন ১১। খেলেন রিভার প্লেটের যুব দলে। সেসময় আতলেতিকো মাদ্রিদ, চেলসি, আয়াক্স ও জুভেন্টাসকে নিয়ে আয়োজন করা হয়েছিল সেভেন-এ-সাইড টুর্নামেন্ট ভেনিস চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। ওই প্রতিযোগিতায় কিশোর এচেভেরি দেখিয়েছিলেন নিজের সামর্থ্য। ৬ ম্যাচে করেন ৯ গোল। রিভারকে চ্যাম্পিয়ন করাতে না পারলেও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে ছিলেন উজ্জ্বল। তার গোল করার দক্ষতা ও পায়ের কাজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে। রাতারাতি তিনি ‘ভাইরাল’!
২০০৬ সালে আর্জেন্টিনার চাকো প্রদেশের রাজধানী রেসিস্তেনসিয়ার জন্ম এচেভেরির। বাবার কাছে ফুটবলের হাতেখড়ি। পরের জার্নিতে পাশে ছিলেন মা ও দুই ভাই। তাদের চেষ্টায় ফুটবল দুনিয়ায় প্রবেশ করেন স্থানীয় ক্লাব দেপের্তিভো লুহান দিয়ে। সেখান থেকেই নজরে পড়েন রিভার প্লেটের স্কাউট টিমের। এরপর আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ক্লাবে ট্রায়াল ও সেখানকার একাডেমিতে ভর্তি। কিন্তু সেই যাত্রাতে আছে মজার ঘটনা। রিভার প্লেট সিলেকশন কর্তৃপক্ষ তাকে দলে নেওয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু এভেচেরি দেন শর্ত!
ওই ঘটনা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন রিভারের সেই সময়কার রিক্রুমেন্ট ডিরেক্টর দানিয়েল ব্রিজুয়েলা, ‘আমরা সবাই মনুমেন্তালের সামনে দাঁড়িয়ে তখন। ওই সময় এচেভেরি এসে বলে, ‘আমি রিভারের ভক্ত। এখানে আসতে চাই। কিন্তু আমার মা না চাইলে কিন্তু আমি চাকোতে ফিরে যাব।’ এচেভেরিকে ফিরতে হয়নি। রিভার প্লেট কর্তৃপক্ষ বুয়েনস এইরেসে তার মায়ের থাকার ব্যবস্থা করে দিলে একাডেমিতে ভর্তি হন তিনি।
চলতে থাকে এভেচেরির বেড়ে ওঠা। ফুটবল দক্ষতা বাড়তে থাকে। ততদিনে ভেনিস চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে দারুণ পারফরম্যান্সে ফুটবল দুনিয়ায় তিনি ভাইরাল। রিভার বুঝতে পারলো ‘সোনার ছেলে’ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই এচেভেরির বয়স যখন ১৬, তখনই তাকে পেশাদার চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় তারা।
এই খেলোয়াড় অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে যেমন কার্যকর, তেমনি লেফট উইংয়েও দুর্দান্ত। এ কারণেই তার মাঝে খোঁজা হচ্ছে মেসিকে। যদিও মেসির মতো তিনি বাঁ পায়ের খেলোয়াড় নন। তিনি ডান পায়ের খেলোয়াড়। তবে তার পায়ে বল ধরে রাখার ক্ষমতা মনে করিয়ে দেয় মেসির কথা।
সেই মেসির সঙ্গে গত বছর দেখা হয়েছে এচেভেরির। যে সময়টা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। প্রিয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও করেছিলেন তিনি। গত বছর তার জীবনে আসে আরেক কয়েকটি দারুণ মুহূর্ত। যার মধ্যে সবার আগে আসবে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের কথা। ছোটদের এই বিশ্বকাপে দুর্দান্ত সময় কাটিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে, পেরুর বিপক্ষে তার পারফরম্যান্স ছিল দেখার মতো। যাতে তিনি আবারও নজরে পড়ে যান ফুটবল দুনিয়ার। আলোচনা হয় সর্বত্র।
প্রতিযোগিতাটি থেকে আর্জেন্টিনা সেমিফাইনালে বাদ পড়ে। তবে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে প্রচারের আলো টেনে নেন নিজের দিকে। ৭ ম্যাচে করেন ৫ গোল, যার মধ্যে আছে ব্রাজিলের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে তার তৃতীয় গোলটি মনে করিয়ে দিয়েছিল মেসির কথা। ক্ষীপ্রগতিতে বল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বক্সের ভেতরে গোলকিপারকে কাটিয়ে লক্ষ্যভেদ- ২০২১ সালে ব্রাজিলের বিপক্ষে মেসি প্রায় একই রকম একটি গোল করেছিলেন। ফলে আর্জেন্টিনার ‘নতুন মেসি’ নামটা আরও জোরালো হয় তার।
ছোটদের ওই বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দিয়েই ইউরোপের বড় দলগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন এচেভেরি। তবে গুঞ্জন-আলোচনা যা হচ্ছিল, তাতে তাকে পাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিল বার্সেলোনা। কাতালান ক্লাবটির কোচ জাভির মুখে ঝরেছিল তার প্রশংসা। তারা চেষ্টাও করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে ম্যান সিটি। ইউরোপের কঠিন ফুটবলে তার যাত্রা হতে যাচ্ছে পেপ গার্দিওলার হাত ধরে।
লাতিন আমেরিকা কাঁপিয়ে এসেছেন এচেভেরি। ছোট্ট ক্যারিয়ারে অনেক স্মরণীয় মুহূর্তের জন্মও দিয়েছেন। তবে ইউরোপের কঠিন ফুটবলে কতটা মানিয়ে নিতে পারেন, সেটাই দেখার।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার