স্টাফ রিপোর্টার:
দীর্ঘ ১৪ মাস পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকালে ২৭৯ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা করা হয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ কমিটিতেও বিতর্কিত বেশ কয়েকজন পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে গত বছরের ২০ ডিসেম্বরে গণভবন থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি ঢাবির আংশিক কমিটি ঘোষণা দেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সভাপতি হিসেবে মাজহারুল কবির শয়ন ও সেক্রেটারি হিসেবে তানভীর হাসান সৈকতের নাম ঘোষণা করা হয়।
তবে কমিটিতে পদ পাওয়া নেতাদের নাম ঘোষণা করার পরপরই আলোচনায় উঠে এসেছে কয়েকজন বিতর্কিত নেতার নাম। এদের মধ্যে ‘উদ্যানের স্বঘোষিত রাজা’, কেউ মাদকসেবী, শিক্ষার্থীদের মারধর ও হল ছাড়া করা, বিরোধী মতাদর্শের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা, এমনকি ছিনতাই করে জেলে যাওয়া নেতাও রয়েছেন।
সদ্য ঘোষিত ঢাবি ছাত্রলীগের কমিটিতে সহ-সভাপতি হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে স্বঘোষিত সোহরাওয়ার্দী ‘উদ্যানের রাজা’ আক্তারুল করিম রুবেলের নাম। যিনি চাঁদা চেয়ে মারধরের ঘটনায় ২০২১ সালের ২৮ জুলাই ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তাকে পদায়ন করতে গতকাল তার বিরুদ্ধে করা বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়। সহ-সভাপতি হিসেবে আরও নাম এসেছে নূর উদ্দীন আহমেদের। তিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগে শাহবাগ থানা পুলিশ কর্তৃক গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কয়েকমাস জেল খেটে বের হয়ে ফের রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনকালে টিএসসিতে সংগঠনের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লাসহ নেতাকর্মীদের মারধরের অভিযোগ রয়েছে শাহনেওয়াজ বাবু ও শাহরিয়াদ শহীদ শুভর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বিজয় একাত্তর হলে এক শিক্ষার্থীকে শিবির সন্দেহে রাতভর মেরে হল ছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে শাহনেওয়াজ বাবুর বিরুদ্ধে। বাবুকে সাংগঠনিক সম্পাদক ও শুভকে উপ-মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক করা হয়েছে।
গত বছরের ৬ আগস্ট মেডিকেল মোড়ে দোকানে চাঁদাবাজি এবং দোকান কর্মচারীকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তুলে নিয়ে মারধর, হুমকি ও মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ রয়েছে বেলায়েত হোসেন রকির বিরুদ্ধে। এ নিয়ে শহীদুল্লাহ হলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরমধ্যে রকি সৈকতের অনুসারী। তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে।
গত বছরের ৬ মে শাহবাগের কবির হোটেলে দাবিকৃত ১০ হাজার টাকা চাঁদা না পেয়ে দুই দফায় ১৪ হাজার টাকার খাবার ফ্রি খাওয়ার অভিযোগ রয়েছে এ এফ রহমান হল ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক উপসম্পাদক সিফাত আহাম্মেদের বিরুদ্ধে। তিনি কমিটিতে সমাজসেবা সম্পাদকের পদ পেয়েছেন।
২০২৩ সালের ১৪ জুলাই রাত দেড়টার দিকে রোকেয়া হলের ১১২১ নাম্বার রুমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আয়েশা সিদ্দিকা রূপাকে মারধর করে টেনেহিঁচড়ে কক্ষ ছাড়া করার অভিযোগ রয়েছে ফারজানা পারভীনের বিরুদ্ধে। তিনি বর্তমান কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ পেয়েছেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষার্থীকে রাতভর পিটিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে আসেন ইউসুফ তুহিন। বর্তমান কমিটিতে কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে তার নাম ঘোষণা হয়েছে।
চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের ভ্রাম্যমাণ এক দোকান মালিকের কাছে চাঁদা চাওয়ার অডিও ক্লিপ ফাঁস হয় তানভীর হোসেন শান্তর। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটির পদে আসতে উপাচার্যের নির্দেশনা অমান্যের অভিযোগও রয়েছে। সদ্য ঘোষিত কমিটিতে তানভীর হোসেন শান্ত নাট্য ও বিতর্ক সম্পাদক পদ পেয়েছেন।
কৃষিশিক্ষা সম্পাদক এমদাদুল হক বাঁধন ১০ মার্চ ২০২২ ঢাবির বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্র পিটিয়ে শিরোনামে এসেছিলেন। স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শিবলী সাদিক ২০২৩ সালের ১১ জুন সাংবাদিক লাঞ্ছিত করে আলোচনায় আসেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনকে ফুল দিতে ঢাবি ক্যাম্পাসে এসে মেহেদী হাসান নিবিড় ও সায়েক্স শাহরিয়ার নিরবের হেনস্তার শিকার হন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঢাবি শীর্ষ নেতৃত্বের টানাপড়েন চলছিল তখন, নিবিড় ১নং সহসভাপতি এবং মাজহারুল ইসলাম শয়নের অনুসারী হিসেবে পরিচিত নিরব প্রচার সম্পাদক পদ পেয়েছেন।
মেহেদী হাসান বর্তমান কমিটির ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাঁজা সেবন এবং উদ্যানের গেটে খাবারে হাত ধোয়ার পানি ফেলার মতো তুচ্ছ ঘটনায় দুইজন সিনিয়রকে পিটিয়ে জখম করার অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯ সালে তুচ্ছ ঘটনায় জগন্নাথ হলে নিলয় কুমার বিশ্বাস নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ রয়েছে সুস্ময় দাসের বিরুদ্ধে। তাকে বর্তমান কমিটির ৯নং সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে।
উপ-সমাজসেবা সম্পাদক মাশিয়াত সরকার উৎসের বিরুদ্ধে এক সহপাঠী নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে।
ফজলুল হক মুসলিম হলের সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে জড়িয়ে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন জিহাদুল ইসলাম। তাকে বর্তমান কমিটির উপ-তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক করা হয়েছে।
গত বছরের ১১ জুন মুহসীন হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে বাকবিতণ্ডায় জড়ায় শিবলি সাদিক। এ ঘটনার ছবি তোলায় এক সাংবাদিককে হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে কমিটিতে স্কুল-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীকে মারধর ও জোর করে সিগারেট খাওয়ানোর অভিযোগ রয়েছে এমদাদুল হক বাঁধনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী হল ছেড়ে দেন। বাঁধন কমিটিতে কৃষিশিক্ষা সম্পাদক পদ পেয়েছেন।
বিতর্কিতদের পদায়নের বিষয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, যেই প্রশ্নটি প্রথম আসে কেউ জেল খেটে আসার পরও কেন পদায়ন করা হয়েছে? আমি বলব, আদালত যদি কাউকে নির্দোষ হিসেবে ঘোষণা দেয় তাহলে আমরা তাকে অপরাধী হিসেবে বলতে পারি না। তাছাড়া গত এক বছরে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। বর্তমানে সে তার কর্মীদের নিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছে। এজন্য আমরা তার ভালো কাজের ফলস্বরূপ পদায়ন করেছি।
তাছাড়া আমরা কোনো চাঁদাবাজিতে লিপ্ত, মাদকাসক্ত, বিরোধী মতাদর্শের নেতাকর্মীদের হামলায় অভিযুক্তদের পদ দেইনি। হয়ত কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে মাত্র কিন্তু সেটা প্রমাণিত নয়। শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা কাউকে পদ বঞ্চিত রাখতে পারি না। আমরা আমাদের কথা অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমাদের নেতাকর্মীদের কাজের পুরস্কার স্বরূপ তাদেরকে পদায়ন করেছি।
সার্বিক বিষয়ে ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, আমরা প্রমাণিত কোনো অভিযুক্তদের পদায়ন করিনি। যাদেরকে পদায়ন করেছি তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে শুধু অভিযোগ রয়েছে যা প্রমাণিত নয়। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছি। তাছাড়া তারা হলেও দায়িত্ব পালন করে এসেছে। শুধু অভিযোগের ভিত্তিকে আমরা কাউকে পদ থেকে বঞ্চিত করিনি। যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত রয়েছে, যারা দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে জয়ী করতে ভূমিকা রেখেছে তাদেরকে বাছাই করে পদায়ন করেছি।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার