সম্পাদকীয়:
সরকার যখন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের স্থলে সাইবার নিরাপত্তা আইন জারি করে, তখনই আমরা এর বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। সে সময় সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন অংশীদার প্রতিষ্ঠানও তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছিল।
কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এসব আপত্তি ও প্রতিবাদ বিবেচনায় না নিয়ে আইনটির ইতিবাচক দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের দাবি, ২০১৮ সালে প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বেশির ভাগ ধারা ছিল অজামিনযোগ্য। কারও বিরুদ্ধে মামলা হলেই তাঁকে অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হতো। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার মাত্র ২ শতাংশের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত শাস্তি পেয়েছেন। এই আইনে অপরাধ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের একজন কর্মকর্তার সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বিবেচনা করা হতো, যা সাইবার নিরাপত্তা আইনেও বহাল আছে।
গত সোমবার ল’ রিপোর্টার্স ফোরাম (এলআরএফ) আয়োজিত ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ও আইন সাংবাদিকতা’ শীর্ষক কর্মশালায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ যেসব কথা বলেছেন, তাতে সাংবাদিক সমাজের উদ্বেগই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে এই বিচারপতি বলেন, ‘আইনের পাঁচটি ধারা (২২, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৮) যেকোনোভাবে আপনাকে বিপদে ফেলতে পারে।…যদিও ২৯ ধারায় মানহানির বিষয়ে হয়তোবা আপনারা জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কয়েকটা সেকশন খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে এই জার্নালিজমে (সাংবাদিকতায়)।’
আইনের ২২ ধারায় ‘ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক জালিয়াতি’ সম্পর্কে বলা হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কোন কাজটি করলে জালিয়াতি হবে, কোনটি হবে না তার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। সে ক্ষেত্রে আইনের অপব্যবহার তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের আশঙ্কা থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘এখনো গেল না আঁধার, এখনো রহিল বাধা।’
এ প্রসঙ্গে বিচারপতি হাসান আরিফ ১৯৯১ সাল–পরবর্তী রাজনীতি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর ভাষায়, ‘১৯৯১ সাল থেকে দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রচণ্ড ইনটলারেন্স আমরা দেখেছি। কোনো ধরনের সমালোচনা হলেই গ্রেপ্তার-অ্যারেস্ট-নির্যাতন ছাড়া আর কোনো পন্থা ওনাদের হাতে আছে বলে ওনারা মনে করেন না।’
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ কোনো নির্দিষ্ট সরকারের আমলের কথা বলেননি। বলেছেন একানব্বই–পরবর্তী অসহিষ্ণু রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা। সমস্যা হলো সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়াকেও অনেক সময়ে বৈরী দৃষ্টিতে দেখা হয়, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মধ্যেও ‘ষড়যন্ত্র’ ও ‘চক্রান্ত’ আবিষ্কার করা হয়। নব্বই–পরবর্তী সব সরকারের আমলেই এ ঘটনা ঘটেছে।
সাংবাদিকদের কাজ জনগণের সামনে সত্য তুলে ধরা। সেটি করতে গিয়ে যদি সাংবাদিকেরা হয়রানি, নির্যাতন ও মামলা–হামলার শিকার হন, তাহলে সাংবাদিকতা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সাইবার নিরাপত্তা আইনে জামিনযোগ্য ধারা বাড়ানো হয়েছে, এটা ইতিবাচক। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আইনটির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ঝুঁকি থাকছে না। সাইবার মাধ্যমের অনেক অপরাধের বিচার দেশের প্রচলিত আইনেও সম্ভব বলে আইনজ্ঞরা মনে করেন।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার