স্টাফ রিপোর্টার:
গত এক বছরে বিভিন্ন ভিসায় যুক্তরাজ্য তথা লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি। এর মধ্যে সিলেট অঞ্চলের মানুষই বেশি। যেসব ভিসায় গিয়েছেন তার মধ্যে স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মীর ভিসা উল্লেখযোগ্য। তবে এমন ভিসায় সে দেশে অনেকেই পড়েছেন চরম বিপাকে।
বেশি কর্মঘণ্টা কাজ, কাজ পাওয়ার জন্য অবৈধভাবে ৩০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত দেওয়া, প্রতিকূল পরিবেশে কাজ ও শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। সর্বোপরি যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন অনেক নারী।
যুক্তরাজ্যে সেবাকর্মীর ভিসায় যাওয়া অভিবাসীরা ধর্ষণ ও শোষণের শিকার হয়েও চাকরি টিকিয়ে রাখতে চুপ থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম দ্য ব্যুরো ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (টিবিআইজি) ও আইনি সহায়তা দানকারী সংগঠন সিটিজেনস অ্যাডভাইস দেড় শতাধিক অভিবাসীর কাছ থেকে এমন তথ্য সংগ্রহ করেছে। ভুক্তভোগীর প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি বলে ধারণা তাদের।
ব্রিটেনে স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মীর ভিসায় আসা ৮০টি প্রতিষ্ঠানের ১৭৫ জনের স্বাক্ষ্য নিয়েছে টিবিআইজি এবং সিটিজেনস অ্যাডভাইস। নিপীড়নের নানা অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন তারা। বার্নিস নামের একজন নারী অভিবাসী বলেন- তিনি যে বাড়িতে কাজ করেন তার মালিকের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
অপর একজন বলেছেন, তাকে ২০ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। নিয়োগদাতার কাছে অভিযোগ করার পর তার ভিসা প্রত্যাহারের হুমকি দেওয়া হয়েছে তাকে।
নিয়োগদাতার হাতে একাধিকবার ধর্ষিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন আবেনা নামের এক নারী। তিনি এ ব্যাপারে পুলিশের কাছে সহায়তাও চাননি। এক পর্যায়ে পেশাদার সম্পর্ক বজায় রাখতে বলায় নিয়োগদাতা তাকে কাজ দেওয়াই বন্ধ করে দেন।
সিটিজেনস অ্যাডভাইস জানিয়েছে- গত বছর তাদের কাছে স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের কর্মীদের সহায়তা চাওয়ার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। সিটিজেনস অ্যাডভাইস ও টিবিআইজে তাদের সাক্ষাৎকারে যেসব অভিযোগ পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, মজুরি চুরি করা, কাজ দেওয়ার জন্য অবৈধভাবে ৩০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত নেওয়া, কর্মঘণ্টার প্রতিশ্রুতি বজায় না রাখা, প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে ও শোচনীয় পরিস্থিতির মধ্যে তাদের থাকতে বাধ্য করা।
তাদের অনেকে এরইমধ্যে খাবার, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য বিল পরিশোধের জন্য ঋণ করতেও বাধ্য হয়েছেন। অন্যদিকে ভিসার শর্তের কারণে বিপদে পড়া এই অভিবাসীরা সরকারি ভাতা বা বাসস্থানের সুবিধাটুকুও পান না।
দেখা গেছে, ভিসা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মীরা সম্পূর্ণ তাদের নিয়োগদাতার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্য সরকার দেশটির স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতি মোকাবিলায় এই ভিসা পদ্ধতি চালু করে। এর আওতায় চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য খাতের পেশাজীবী কিংবা বয়স্কদের সেবাদাতারা যুক্তরাজ্যে যাওয়ার সুযোগ পান।
যুক্তরাজ্য সরকারের হিসাবে ২০২৩ সালে এক লাখ ২১ হাজার ২৯০ জনকে স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মীর ভিসা দেওয়া হয়েছে; যা তার আগের বছরের প্রায় তিনগুণ বেশি। ২০২২ সালে সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ১৯৪ জন। আগতদের মধ্যে ওপরের দিকে আছেন ভারত, নাইজেরিয়া, জিম্বাবুয়ে, ঘানা, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নাগরিকরা। দেশটির হেলথ ফাউন্ডেশনের হিসাবে চাহিদা পূরণে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও এক লাখ ২২ হাজার সেবাকর্মীর প্রয়োজন।
এই ভিসা পাওয়ার শর্ত হিসেবে আবেদনকারীর কাছে অবশ্যই অনুমোদিত কোনও নিয়োগদাতার পাঠানো চাকরির প্রস্তাব থাকতে হবে; যারা মূলত স্পন্সর নামে পরিচিত। শর্ত অনুযায়ী, নিয়োগদাতা যুক্তরাজ্য পৌঁছানো মাত্রই তার কাজের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু ভিসা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তারা পুরোপুরি স্পন্সরকারীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ওয়ার্কার রাইটস সেন্টার নামের একটি সংস্থার প্রধান নির্বাহী ডোরা অলিভিয়া ভিকল জানান, এই ব্যবস্থাটির কারণে বিপদে পড়ার ভয়ে নিপীড়নের বিষয়ে কর্মীরা কর্তৃপক্ষের কাছেও অভিযোগ করার সাহস পান না।
এছাড়া ভিসাবিধির কারণে নানা জটিলতায় পড়েছেন স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা। চাকরি ছাড়লে সরকারি কোনও ভাতা তাদের মেলে না। বরং চাকরি ছাড়ার মাত্র ৬০ দিনের মধ্যে নতুন কাজ যোগাড় করতে হয়। বাসস্থানের জন্যও তাদের নিয়োগদাতার ওপর নির্ভর করতে হয়। কিছুক্ষেত্রে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে নিয়োগ ব্যয় পরিশোধেও তারা চুক্তিবদ্ধ থাকেন।
সিটিজেনস অ্যাডভাইসের নীতিবিষয়ক পরিচালক কাইলে হিগনেল বলেন, ‘‘এই ব্যবস্থায় আনুমানিক কয়েক হাজার মানুষ আটকা পড়েছেন যারা নিপীড়ন, হুমকির মুখে ঝুঁকির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, যাদের অভিযোগ জানানোর ক্ষমতা নেই এবং অনেক সময় কয়েক হাজার পাউন্ড লোকসানে পড়েন।’’
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘এই মানুষেরা দক্ষ পেশাজীবী যারা আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাটি চালু রাখছেন- অথচ বিপদের সময় তাদেরই কোনো নিরাপত্তা নেই।’
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার