আতাউর রহমান:
রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবিরকে খেলার মাঠে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ওই নৃশংসতার পর ঢাকাসহ দেশজুড়ে কিশোর গ্যাংয়ের নির্মমতার বিষয়টি সামনে আসে। গত ৬ বছরেও সেই ঘটনার বিচার শেষ হয়নি। ‘ডিসকো বয়েজ’ ও ‘নাইন স্টার গ্রুপ’সহ জড়িত সন্দেহে ২৬ জন গ্রেপ্তার হলেও জামিন পেয়ে যায় তারা।
হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা থেমে যায়নি; বরং তা দেশজুড়ে ছড়িয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশে এখন এ ধরনের কিশোর গ্যাং বা গ্রুপ রয়েছে ১৮০টি। এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ৬৭৭। জানা গেছে, এই কিশোর গ্যাংয়ের হাতে গত বছরেই খুন হয়েছেন ২৬ জন। তাদের হামলায় আহত হন ৩২৯ জন। এর মধ্যে গত শনিবার রাজধানীর পল্লবীতে খুন হন একজন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতার ঘটনায় গত এক বছরে ৩৭৯টি মামলা হয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়। এসব মামলায় ৯৪০ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় গ্রেপ্তারের পর ১৯৭ জনকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে তদন্ত শেষ করে ৩৩৫টিতে চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে আদালতে। ১০টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তদন্তে অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রমাণ হওয়ায় ঢাকা মহানগর এলাকায় ৭৭ আসামির বিরুদ্ধে ২২ দোষীপত্র এবং চট্টগ্রাম মহানগরে ১৫ আসামির বিরুদ্ধে চারটি দোষীপত্র জমা দেওয়া হয় আদালতে। এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জের থানাগুলোতে ১৬ আসামির বিরুদ্ধে পাঁচটি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ৪৬ জনের বিরুদ্ধে ১১টি, সিলেট রেঞ্জে দুজনের বিরুদ্ধে একটি এবং বরিশাল রেঞ্জে দুজনের বিরুদ্ধে একটি দোষীপত্র জমা দেওয়া হয়।
কিশোর গ্যাং কালচার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও অপরাধ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান কালবেলাকে বলেন, প্রযুক্তির অপব্যবহারে কিশোরদের মধ্যে হিরোইজমের একটা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে। এসব কারণেও তারা গ্রুপিংয়ে জড়াচ্ছে। তা ছাড়া অনেকে রাজনৈতিক স্বার্থে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করছে।
তিনি বলেন, সমাজে যেভাবে কিশোর অপরাধ হচ্ছে, সেগুলো থেকে রেহাই পেতে সাংগঠনিকভাবে আরও উন্নত হতে হবে আমাদের। কিশোর সংশোধনাগারগুলো আরও উন্নত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এই কিশোর গ্যাং নির্মূলে বিশেষ সেল গঠন করা উচিত। পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ এবং এলাকাভিত্তিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো আগের মতো নেই। সমাজে মাদকের ব্যাপক একটা অপব্যবহার রয়েছে। চলমান গ্যাং কালচার এসবের অন্যতম কারণ। এগুলোও ভাবনায় আনতে হবে।
কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতার ঘটনায় দায়ের কয়েকটি মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলমান এই অপরাধী গ্যাং বা গ্রুপগুলোর নামের সঙ্গে কিশোর শব্দটি থাকলেও এদের প্রায় সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। গত রোববার র্যাব-৩-এর সদস্যরা রাজধানীর কদমতলী ও হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের প্রত্যেকের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। বয়স যা হোক, কিশোর গ্যাংয়ের এই সদস্যরা রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক কারবার, মাদক সেবন, ভাড়ায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম থেকে শুরু করে খুন—সব অপরাধই করে চলেছে।
বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি গ্রুপের নেপথ্যে এলাকার বড় ভাইদের হাত রয়েছে। মূলত এই বড় ভাইদের হাতেই কিশোর গ্যাংয়ের নাটাই, তাদের স্বার্থেই ব্যবহৃত হয় কিশোর গ্যাং নামের উঠতি সন্ত্রাসীরা। কিশোর গ্যাংয়ের এই পৃষ্ঠপোষকদের কেউ জনপ্রতিনিধি, কেউ রাজনৈতিক পদধারী নেতা।
পুলিশ সদর দপ্তরে অপারেশনস বিভাগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত আইজিপি আনোয়ার হোসেন গতকাল সোমবার বলেন, প্রতি মাসের ক্রাইম কনফারেন্সে এই কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা দমনের বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয় মাঠ পুলিশের কর্মকর্তাদের। পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমেও এসব গ্যাংয়ের নাম সংগ্রহ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, এই কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে কোন বড় ভাই থাকল, তা দেখার বিষয় নয়। সারা দেশে পুলিশের প্রত্যেক ইউনিটে নির্দেশনা রয়েছে—অপরাধী যে-ই হোক, আইনের আওতায় আনতে হবে।
কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতায় মামলার হালচাল: কিশোর গ্যাং সংগঠিত অপরাধগুলোর মধ্যে ডিএমপিতে দায়ের ৬২ মামলার মধ্যে ৫৪টিতে অভিযোগপত্র ও দুটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হলেও ৬টি মামলা তদন্ত চলছে। এসব অভিযোগপত্রে আসামি ৩২৩ জন এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২২৯ জনকে। ডিএমপিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় ৪৬ জন আহত ও ১১ জন নিহত হয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় ৮৫ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৮৮ জনকে। ৭৫টি মামলায় চার্জশিট ও দুটিতে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হলেও তদন্ত চলছে ৮ মামলার। এসব অভিযোগপত্রে আসামির সংখ্যা ২৪৩ জন। চট্টগ্রামে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় দুজন নিহত হলেও আহত হয়েছে ৫৪ জন। গত এক বছরে খুলনা ও সিলেট মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের খাতায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা না থাকলেও রাজশাহী মেট্রোপলিটন এলাকায় তিনটি মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকাতেও একটি মামলা হয়। গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় ৮টি মামলার ৮টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ৩৬ জন গ্রেপ্তার হলেও চার্জশিটভুক্ত আসামি ৪১ জন।
এদিকে ঢাকা রেঞ্জে ১৩৪ মামলায় ১২১টিতে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। এসব চার্জশিটে ৪১৫ জন কিশোর গ্যাং সদস্য থাকলেও গ্রেপ্তার করা হয় ২৮৬ জনকে। এই অপরাধীদের হামলায় ১১৯ জন আহত হন এবং নিহত হন ছয়জন। ময়মনসিংহ ও রংপুর রেঞ্জে এ ধরনের অপরাধীদের তৎপরতা না থাকলেও রাজশাহী রেঞ্জে ছয়টি মামলায় আসামি ১৯ জন। ওই রেঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয় একজন। চট্টগ্রাম রেঞ্জে ৪০ মামলায় আসামি ২২৬ জন, এদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয় ১০৬ জন। এ ছাড়া খুলনা রেঞ্জে ৯টি মামলায় আসামি ৫১, সিলেট রেঞ্জে পাঁচ মামলায় ২০ জন এবং বরিশাল রেঞ্জে ২৫ মামলায় ৫৩ কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে।
রাজধানীতে সক্রিয় ৮০ কিশোর গ্যাং: ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্র জানায়, রাজধানীর আটটি ক্রাইম বিভাগে অন্তত ৮০ কিশোর গ্যাং রয়েছে। এরা মূলত মাদক কারবার, পাড়া-মহল্লায় মারামারি, দখল, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ইভটিজিংসহ নানা অপরাধে সরাসরি জড়িত। এরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ কার্যক্রম চালায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগে সাতটি কিশোর গ্যাংয়ে ১২১ সদস্য, মিরপুর বিভাগে ১৩টি গ্রুপে ১৭২ সদস্য, রমনা বিভাগে সাতটি গ্রুপে ১১৩ সদস্য, লালবাগ বিভাগে দুটি গ্রুপে অন্তত ৩০ সদস্য, উত্তরা বিভাগে পাঁচ গ্রুপে ৭০ সদস্য, ওয়ারী বিভাগে ছয় গ্রুপে ১০৮ সদস্য, মতিঝিল বিভাগে ৫ গ্রুপে ৪১ সদস্য এবং গুলশান বিভাগে সাতটি গ্রুপে ৬২ সদস্য সক্রিয় রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার (অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, কিশোর গ্যাং নির্মূলে পুলিশের অভিযান চলছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিশোর গ্যাং নির্মূলে প্রতিটি থানায় নির্দেশনা দেওয়া আছে। কিশোর গ্যাং বা যেই হোক—অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে না।
ঢাকার কোন এলাকায় কোন গ্রুপ সক্রিয়: পুলিশ সূত্র ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় শাকিল গ্রুপ, মামুন গ্রুপ, মোহাম্মদপুর এলাকায় গাংচিল গ্রুপ, ঘুটা দে গ্রুপ, শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় জাকিরের গ্রুপ, আদাবর থানা এলাকায় দ্য কিং অব গাইরালা, ভইরা দে গ্রুপ, অনলি কোপাইয়া দে গ্রুপ, তেজগাঁও থানা এলাকায় কানা জসিমের গ্রুপ, মাইনুদ্দিনের গ্রুপ, মিরপুর এলাকায় অপু গ্রুপ, বগা গ্রুপ, ভাস্টর গ্রুপ, দারুস সালাম থানা এলাকায় এল কে ডেভিল বয়েজ ও এল কে তালতলা বয়েজ গ্রুপ, পটেটো রুবেল গ্রুপ, অতুল গ্রুপ, পল্লবী থানা এলাকায় আশিক গ্রুপ, রকি গ্রুপ, পিন্টু-কাল্লু গ্রুপ, মুসা-হারুন গ্রুপ, রোমান্টিক গ্রুপ, সোহেল গ্রুপ, রূপনগর থানা এলাকায় রুবেল গ্রুপ, ইয়াসিন গ্রুপ এবং ইমন গ্রুপ বেশ সক্রিয়।
রমনা থানা এলাকায় বেইলি কিং রন গ্রুপ, শাহবাগ এলাকায় অলি গ্রুপ, কলাবাগান থানা এলাকায় জসিম গ্রুপ, হাজারীবাগ এলাকায় লাভ লেন গ্রুপ, বাংলা গ্রুপ, পারফেক্ট গ্যাং, সুমন গ্রুপ, লাড়া দে গ্রুপ, কদমতলী থানা এলাকায় শুক্কুর গ্রুপ, লিটন গ্রুপ, গেন্ডারিয়া থানা এলাকায় তাহমিদ গ্রুপ, ডেমরা থানা এলাকায় সাঈদ গ্রুপ, মুগদায় চান যাদু গ্রুপ, বিচ্ছু বাহিনী, রামপুরায় আকিল অ্যান্ড কোং, শাহজাহানপুরে নিবিড় গ্রুপ, বংশালে জুম্মন গ্রুপ, চকবাজার এলাকায় টিকটক হৃদয় গ্রুপ, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় ইয়ামিন ও ফয়সাল গ্রুপ এবং নাসির গ্রুপ বেশি সক্রিয়। উত্তরা এলাকায় নাইন স্টার, রুবেল গ্রুপ, এইচবিটি হিটার বয়েজ গ্রুপ, সানি গ্রুপ, দক্ষিণখানে ইয়াং স্টার গ্রুপ, বিগ বস গ্রুপ, তুরাগ এলাকায় রানাভোলা কিং মহল, জিদান গ্রুপ, উত্তরখান এলাকায় শাহিন অ্যান্ড রিপন গ্যাং, সলেমন গ্যাং, গুলশান এলাকায় ডি-নাইট গ্রুপ সক্রিয় বলে জানা গেছে। এসব গ্রুপে নতুন নামে আবার উপগ্রুপও রয়েছে।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার