প্রবাস ডেস্ক:
সেই দিনটিও ছিল আর দশটি দিনের মতোই। সৌদি রাজপরিবারের চিরাচরিত ভাবগাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য নিয়ে তৎকালীন বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ রাজপ্রাসাদে কুয়েতি একটি দলকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কুয়েতি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু, কীভাবে আলোচনাটি ফলপ্রসূ হতে পারে, সকাল থেকে এ নিয়ে বাদশাহকে ব্রিফ করছিলেন তেলমন্ত্রী শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানি। কে জানত, ওই দিনই রাজপ্রাসাদে ঘটে যাবে হৃদয়বিদারক এক ঘটনা।
দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ। আর আজ ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ। সময়ের ব্যবধান ৪৯ বছর। কী ঘটেছিল সেদিন সৌদি রাজপ্রাসাদে?
বলা হয়ে থাকে, রাজপ্রাসাদের অন্দরের খবর সাধারণ মানুষের কাছে নিখুঁতভাবে পৌঁছায় না। পৌঁছালেও তা ভিন্নভাবে পৌঁছায়।
তবে সেদিনের ঘটনাটি বাইরের মানুষ জানতে পারেন সঠিকভাবে। কারণ, সেদিন তেলমন্ত্রী জাকি ইয়ামানির জন্য বাসায় অপেক্ষা করছিলেন তাঁরই ১৮ বছর বয়সী মেয়ে মেই ইয়ামানি। রাজপ্রাসাদ থেকে তেলমন্ত্রীর অ্যাপার্টমেন্টের দূরত্ব ছিল কয়েক মাইল।
মেই ইয়ামানি এখনো বেঁচে আছেন। তাঁর বয়স হয়েছে ৬৮ বছর। বসবাস করেন লন্ডনে। সৌদি আরবের নারীদের মধ্যে তিনি প্রথম পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত। একজন সুলেখক হিসেবে তাঁর পরিচিতি রয়েছে।
সেদিন দুপুরের পর বাড়ি ফিরলেন তাঁর বাবা জাকি ইয়ামানি। চেহারায় গভীর উদ্বেগের ছাপ। মেই ইয়ামানিও বাবাকে দেখে বুঝতে পারেননি, খানিকক্ষণ আগে রাজপ্রাসাদে কী ঘটে গেছে। তাঁর বর্ণনায়, ‘আমি বাবার ঘরে বসে অপেক্ষা করছি। চারদিকে বইপত্র। বাবা ঘরে ঢুকলেন। তাঁর মুখশ্রীতে গভীর বেদনার ছাপ, দৃষ্টি অদ্ভুত। বাবা সোজা হেঁটে খাবার ঘরে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে বাবা চিৎকার দিয়ে উঠলেন। একটি শব্দই কেবল তিনি বলতে পারলেন। মুসিবা’, যার অর্থ ভয়ংকর বিপদ।’
সেদিন তেলমন্ত্রী জাকি ইয়ামানির এই আচরণ ছিল একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। কারণ, সবাই তাঁকে একজন বিচক্ষণ, ধীরস্থির, নম্রভাষী মানুষ হিসেবেই জানত। তাহলে সেদিন তিনি এমন আচরণ করলেন কেন? করবেনই-বা না কেন! বাদশাহ ফয়সাল তো ছিলেন তাঁর সবকিছু—গুরু, বন্ধু, পথপ্রদর্শক। অথচ তাঁর কিনা এমন পরিণতি হলো। তা-ও আবার তাঁর চোখের সামনে! কীভাবে সইবেন এই কষ্ট তিনি।
ঘটনাটি তেলমন্ত্রী জাকি যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেটা শুনেই লিখেছেন মেই ইয়ামানি।
আগেই বলেছি, সেই দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ। সকাল থেকে রাজপ্রাসাদে কুয়েতি প্রতিনিধিদলের জন্য অপেক্ষা করছেন বাদশাহ ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে ব্রিফ করছেন তেলমন্ত্রী জাকি ইয়ামানি। কুয়েতি তেলমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করল। এই দলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন একজন যুবরাজ, তাঁর নাম ফয়সাল বিন মুসাইদ। তিনি বাদশাহ ফয়সালের সৎভাইয়ের ছেলে, অর্থাৎ তাঁর ভাইপো।
ভাইপোকে আলিঙ্গন করার জন্য দুহাত বাড়িয়ে দিলেন বাদশাহ। সৌদি সংস্কৃতি অনুযায়ী, একটু ঝুঁকে পড়ে তাঁকে চুমু খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, অমনি ভাইপো পকেট থেকে ছোট্ট পিস্তল বের করলেন। বাদশাহ ফয়সালের মাথা লক্ষ্য করে পরপর তিনটি গুলি করলেন।
প্রথম গুলিটি বাদশাহর চিবুকে লাগে। দ্বিতীয় গুলিটি কান ঘেঁষে চলে যায়। একজন রক্ষী অকস্মাৎ এগিয়ে এলেন। খুললেন তাঁর খাপবদ্ধ তলোয়ার। আঘাত করলেন যুবরাজকে। তেলমন্ত্রী জাকি চিৎকার করে উঠলেন, যুবরাজকে হত্যা করা যাবে না।
তখনো বেঁচে ছিলেন বাদশাহ ফয়সাল। সঙ্গে সঙ্গে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাঁকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। কিন্তু তেমন কোনো চিকিৎসার সুযোগই পেলেন না চিকিৎসকেরা। তাঁরা বাদশাহর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করলেন।
খবরটি প্রচারিত হলো সৌদি আরবসহ সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে। রিয়াদের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেল। লোকজন সব চুপ, কারও মুখে কোনো কথা নেই। কেন খুন হতে হলো ইসলামের দুই পবিত্র মসজিদের রক্ষক, সৌদি আরবের আধুনিকায়নের রোলমডেল তাদের বাদশাহ ফয়সালকে?
কী পরিণতি হয়েছিল হত্যাকারী যুবরাজের? এ ঘটনায় হত্যাকারী যুবরাজকে মস্তিষ্কবিকৃত বলে প্রাথমিকভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু সৌদি চিকিৎসকদের একটি দল তাঁকে সুস্থ হিসেবে ছাড়পত্র দেয়। তাই বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। রাজধানী রিয়াদে প্রকাশ্যে তাঁর শিরশ্ছেদ করা হয়, যা প্রত্যক্ষ করেন হাজারের বেশি জনতা।
কেমন মানুষ ছিলেন বাদশাহ ফয়সাল
বাদশাহ ফয়সাল কেমন মানুষ ছিলেন, এই আলোচনা করতে গেলে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে সামান্য একটু ইতিহাসে।
সৌদি আরবের আজকের এই রাজবংশ, এটা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাদশাহ ফয়সালের বাবা আবদুল আজিজ আল সৌদ, যাঁকে বলা হয় আধুনিক সৌদি আরবের জনক। আরব উপদ্বীপকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আবদুল আজিজ যে লড়াই চালান, তাতে অংশ নিয়েছিলেন ফয়সালও।
আবদুল আজিজ বাদশাহ হন ১৯৩২ সালে। তাঁর কার্যকাল ছিল ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত। এ সময়েই (১৯৩৮ সালে) সৌদি আরবে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়। তেলের খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর বাদশাহ আজিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিভিন্ন গোত্রে ২২টি বিয়ে করেন। তাঁর সন্তান ছিল শতাধিক, যাঁদের মধ্যে ছেলে ৪৫ জন।
১৯৫৩ সালে বাদশাহ আজিজের মৃত্যুর পর নতুন বাদশাহ হন তাঁর ছেলে সৌদ বিন আবদুল আজিজ। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত। এরপর বাদশাহ হন ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ, যাঁকে নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। বাবা ও ভাই—উভয়ের শাসনামলেই পররাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এখনকার প্রধানমন্ত্রী ও ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁর সংস্কারকাজের জন্য দেশ-বিদেশে পরিচিত। কিন্তু সৌদি আরবে প্রকৃত সংস্কার এনেছিলেন বাদশাহ ফয়সাল। ষাটের দশকের মাঝামাঝি তিনি সৌদি আরবে প্রথম টেলিভিশন স্টেশন চালু করলেন। মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর উদ্যোগ নিলেন। এ কাজে এগিয়ে এলেন রানি এরফাদ। তিনি মেয়েদের জন্য স্কুল চালু করলেন। তাঁর স্কুলের প্রথম নয়জন নারী শিক্ষার্থীর একজন ছিল তেলমন্ত্রীর মেয়ে মেই ইয়ামানি।
বহুবিবাহ তখন সৌদি সমাজে ডালভাতের মতো ব্যাপার। বাদশাহ বহুবিবাহকে নিরুৎসাহিত করলেন। নিজেও বহুবিবাহের পথে যাননি। একসঙ্গে একের অধিক স্ত্রী তাঁর ছিল না।
রক্ষণশীল সৌদি আরবে এমন পদক্ষেপ ছিল অকল্পনীয়। স্বয়ং রাজপরিবার থেকে বিরোধিতা শুরু হলো। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হলো রাজপরিবারের রক্ষণশীল অংশ। তাই টেলিভিশন স্টেশন চালু হলে সেখানে সশস্ত্র হামলা হলো। বাদশাহ ফয়সালেরই এক ভাই এই হামলায় নেতৃত্ব দেন, যিনি সেদিন নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড রাজপরিবারের মধ্যে এনে দিল চরম বিভক্তি। প্রসঙ্গত, বাদশাহ ফয়সালকে হত্যা করেন যে যুবরাজ, তিনি মূলত টিভি স্টেশনে হামলা করতে গিয়ে নিহত ব্যক্তির ছেলে।
সে সময় দুনিয়াটা কেমন ছিল
বাদশাহ ফয়সাল একই সঙ্গে ধর্মপরায়ণ ও বিচক্ষণ ছিলেন। পশ্চিমারা কেউ কেউ তাঁকে ধূর্তও বলেছেন। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের পক্ষের লোক।
১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের অনেক জায়গা দখল করে নেয় ইহুদি রাষ্ট্রটি। ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর মিসর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে একটি আরব জোট ইসরায়েলের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। আরব এ যুদ্ধে তখন যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করে।
বিশ্বে তখন চলছে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ুযুদ্ধ। সোভিয়েত নেতা লিউনিদ ব্রেজনেভ সিরিয়া ও মিসরের কাছে সামরিক সহায়তা পাঠাতে শুরু করলেন। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনও ইসরায়েলের জন্য সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করলেন। এটা আরব বিশ্বকে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ করল।
যুদ্ধের ১১ দিনের মাথায় তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেলের উৎপাদন কমানোর ঘোষণা দিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস, পর্তুগালসহ যেসব দেশ ইসরায়েলকে সমর্থন করল, সেসব দেশে তেল রপ্তানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলো। এতে বেধে গেল হুলুস্থুল কাণ্ড। বেড়ে গেল জ্বালানি তেলের দাম। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ২ দশমিক ৯০ মার্কিন ডলার থেকে একলাফে বেড়ে হলো ১১ দশমিক ৬৫ মার্কিন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি রেশনিং ব্যবস্থা আরোপ করতে বাধ্য হলো, যা মার্কিন জনগণ একেবারেই মেনে নিতে পারেনি। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তো তখন চুল ছেঁড়ার অবস্থা। আজ মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশে যান, তো কাল অন্য দেশে। যুক্তরাষ্ট্র ভালোমতো শিক্ষা পেয়েছিল, উপলব্ধি করেছিল যে মধ্যপ্রাচ্যের তেল সরবরাহ নিয়ে আর হেলাফেলা করা যাবে না। বলা হয়ে থাকে, তেলকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার এই বুদ্ধি ছিল বাদশাহ ফয়সালের। তিনি চেয়েছিলেন, ইসরায়েল যেন অধিকৃত এলাকা ছেড়ে চলে যায়। মনেপ্রাণে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন বাদশাহ।
বাদশাহ ফয়সালের আরেকটি সেরা কাজ হলো জ্বালানিনীতি প্রবর্তন। তেলমন্ত্রী জাকি ইয়ামানিকে নিয়ে এই নীতি বানিয়েছিলেন তিনি, যার মধ্য দিয়ে সৌদি আরব তার তেলসম্পদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পেয়েছিল।
অনেক বিশ্লেষকই বলতে চেয়েছেন, বাদশাহ ফয়সাল হত্যার পেছনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ জড়িত ছিল। কারণ, এটা কেবল একজন যুবরাজের ব্যক্তিগত ক্ষোভের বিষয় হতে পারে না। যদিও মোসাদের বিরুদ্ধে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর তথ্যপ্রমাণ না পাওয়াই স্বাভাবিক; কারণ, মোসাদ প্রমাণ রেখে কোনো কাজ করে না।
তবে বাদশাহ ফয়সাল নিহত হওয়ার পর ইসরায়েল হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কারণ, তাঁর মতো করে আর কোনো সৌদি বাদশাহ ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের এতটা বিরোধিতা করেনি।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার