আব্দুল খালিক:
সিলেটের মধ্যে বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ উপজেলা রাজনীতি সচেতন এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখানে বিএনপির ও আওয়ামীলীগ প্রায় সমান শক্তিশালী। তবে জাতীয় পার্টি, জামায়াতও তাদের চেয়ে পিছিয়ে নেই। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি স্থানীয় সকল কর্মসূচী এখানকার দলগুলো যথাযথ পালন করলেও তাদের মধ্যে হানাহানি প্রায় ছিল না বলা যায়। রাজনৈতিক এ দলগুলোর নেতাদের মধ্যে সংখ্যতা ছিল, আন্তরিকতাও ছিল উল্লেখ করার মত। সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনের বর্তমান নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি ও সাবেক সংসদ সদস্য ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন, গৌছ উদ্দিন ও শরফ উদ্দিন খছরু, এই চার সাংসদ এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন? এনিয়ে সাধারণ মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন সিলেট-৬ বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র থেকে বিজয়ী হলেও তিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগদান করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বে এবং পরে নিজ উদ্যোগে যথেষ্ট উন্নয়ন করেছেন বলে তিনি দাবী করেন। ড. মকবুল সিলেটের গত বছরে নিজ বাসায় ইন্তেকাল করেছেন। বিগত নির্বাচনে তিনি বিএনপি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামীলীগ প্রার্থী নুরুল ইসলাম নাহিদের কাছে পরাজিত হন। ড. মকবুল হোসেন নির্বাচনের সময় এলেই তিনি এলাকায় গনসংযোগ শুরু করতেন। ড. মকবুল হোসেনকে বিয়ানীবাজার বিএনপির একটি অংশ সম্প্রতি সময় অবাঞ্চিত ঘোষণা করলেও প্রায় সময় তিনি এলাকায় এসে ঘুরে যেতেন। ১৯৮৭ সনে স্বৈরচার এরশাদ সরকার পতনের দাবীতে সংসদ সদস্য পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে সংসদে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্তাপন করেন সাবেক সংসদ সদস্য ও স্বরাষ্টমন্ত্রী অব্দুল মতিন। তিনি বাদী করেন, সংসদ সদস্য থাকাকালীন সময় বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন।
সাবেক এমপি গৌছ উদ্দিন সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনের তার বন্ধু আফরুজ বস্ক্রকে হত্যার দায়ে সিলেটের একটি আদালত তাকে মৃত্যুন্ডের আদেশ দিলে তিনি এ আদেশ মাথায় নিয়ে দীর্ঘ ৩০ বছর থেকে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এক সময়ের দাপিয়ে বেড়ানো সাবেক এমপি জাতীয় পাটির নেতা গৌছ উদ্দিন এমপি থাকাকালে জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করে খুন করেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সিলেটের শীর্ষ ব্যবসায়ী আফরুজ বক্সকে। খুন করে তিনি পালিয়ে যান সীমান্তের ওপারে পশ্চিমবঙ্গের কমিরগঞ্জ এলাকায়। সেখানে পরিবারহ বসবাস করেন সাবেক এই এমপি গৌছ উদ্দিন। সেখানে তিনি চাউল এর বড় ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। করিমগঞ্জে ব্যবসা করে প্রচুর ভূ-সম্পত্তির মালিকও হয়েছেন তিনি। বিগত কিছু দিন পূর্বে তিনি ভারতে করিমগঞ্জে ইনন্তেকাল করেন। সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনের সাবেক জাতীয় পার্টি নেতা গৌছ উদ্দিনের বহু কর্মকান্ড এখনও ভুলতে পারেনি বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ সাধারণ মানুষ। সে সময়ের রাষ্ট্রপতি ছিলেন স্বৈরশাসক এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ। ফাঁসির দন্ড মওকুফ করতে এমপি গৌছ তৎকালিন সময রাষ্ট্রপতি কাছে ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু চাঞ্চল্যকর এই খুনের ঘটনায় রাষ্ট্রপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ তাকে ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না বলে সূত্রে জানা গেছে। সেই থেকে সে সময় এমপি প্রার্থী মোস্তাফা আল্লামা। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার সময় নিশ্চিত পরাজয় জেনে বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার দুই ইউএনওকে জিম্মি করে ফলাফল নিজ আয়ত্বে নেন গৌছ। সেই তেকে তার অপকর্মের শুরু। জাতীয় পার্টির টিকেটে নির্বাচিত গৌছ উদ্দিন এমপি থাকাবস্থায় ১৯৯০ সালের ১৭ মে সিলেট নগরীর একটি আবাসিক হোটেলে জিজের পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করেন আফরুজ বক্সকে। আফরুজ বক্স এব বর্তমান বাসা সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার কদমতলীর বিয়ানীবাজার রোডের ওভারব্রীজের পূর্ব উত্তর দিকে। নিহত আফরুজ কক্সের স্ত্রী সোনারুন বক্স (৬৩) কেঁদে কেঁদে বলেন, ফাঁসির দÐ নিয়ে একজন আসামী এতদিন পালিয়ে থঅকলেও রাষ্ট্র তার দÐ কার্যকরে কোন পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি বলেন, ৩ সন্ত্রান নিয়ে আমি অসহায় সাহরে ভেসে চলেছি। আমার স্বামীকে হত্যার পর আমাদের সব সহায় পস্পদ হারিয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, খুনী গৌছ বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় আমার স্বামীকে খুন করল। পরদিন লাশ কোলে থাকা সাড়ে ৩ মাসের মেয়ে তানিয়া বক্সকে নিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। দীর্ঘ ২৩ বছর পরও এই স্মৃতি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাবেক এমপি গৌছ এর সিলেটস্থ জিন্দাবাজারের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সবই এলোমেলো। তার বড় ভাই কয়েক বছর পূর্বে বরণ করেছেন। পরিবারের কেউই সাবেক এমপি গৌছ এর সন্ধান দিতে পারেনি। কেউ বলছেন প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আবার কেউ বলছেন লন্ডনে পরিবারসহ বসবাস করছেন। জিন্দাবাজারস্থল পয়েন্টে গিয়ে এমপি গৌছ এর নাম বললেই সবাই বলে সেই গৌছ নাকি। একটু সামনেই তার বাসা। তবে বিশ্বস্থ সূত্র জানায়, তিনি পর্তুগালে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন।
সাবেক এমপি শরফ উদ্দিন খসরু ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে বিয়ানীবাজার গোলাপগঞ্জ আসনে নির্বাচিত করে বিজয় হন। পরবর্তীতে ৯৬ প্রহসনমূলক নির্বাচলেও অল্প কিছু দিনের জন্য সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে কোন দলের মনোনয়ন না পেয়ে যুক্তফ্রন্ট (পিডিপি) থেকে কুলা প্রতিক নিয়ে এ আসনে নির্বাচন করলেও তিনি পরাজিত হন। তিনি ১৯৯৫ এ বিএনপিতে যোগদান করেন। ১৯৯৯ এর শেষের দিকে আবারও জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ তাকে দলে নিয়ে যান। বর্তমানে তিনি সিলেট জেলা জাতীয় পার্টির সদস্য পদে রয়েছেন।
সিলেট-৬ আসনে ১৯৭০-১৯৭২-১৯৭৫ সালে এডভোকেট আব্দুর রহিম, মসউদ আহমদ চৌধুরী ১৯৭৬-১৯৮১, ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন ১৯৮১-১৯৮৬, মো: গৌছ উদ্দিন ১৯৮৬-১৯৯০, সরফ উদ্দিন খসরু ১৯৯১-১৯৮৬ নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৯৬-২০০১, ডা. সৈয়দ মকবুল হোসেন ২০০১-২০০৭ সালে এমপি হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। বর্তমান এমপি নুরুল ইসলাম নাহিদ ২০০৮ সাল থেকে আজ অবদী জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে বিজয়ী হন। তার অবদানের কথা এখনো সাধারণ মানুষ মনে করছেন। বিশেষ করে এডভোকেট আব্দুর রহিম এমপিকে স্মরণ করেছেন এ অঞ্চলের মানুষ।
এ অঞ্চলের কৃতিমান পুরুষ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ১৯৯৬ সংসদ সদস্য ছিলেন। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৬ আসন থেকে পুনঃরায় নির্বাচিত হলে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে নুরুল ইসলাম নাহিদকে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। তিনি এ দায়িত্ব পেয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করেছেন। তিনি বর্তমান সরকারের আলোচিত শিক্ষামন্ত্রী। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চল বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এ অঞ্চলের মানুষ তাকে তার অবদানের জন্য মনে করেছেন। শুধু শিক্ষা ব্যবস্থা নয় রাস্তাঘাট, কালভার্ট, বিয়ানীবাজার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে, ফায়ার সার্ভিস ষ্টেশন, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, হাওর উন্নয়ন, সদাখাল ব্রীজ নদী খনন, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন করেছেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ এই প্রথম আধুনিক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে বলে সাধারণ লোকজন মনে করেন। প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রামে রাস্তাঘাট আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিছু কিছু গ্রামে এখনো রাস্তাঘাট কাচা কালভার্ট বিদ্যুৎ পৌছেনি। আওয়ামীলীগের উপজেলা নেতাকর্মীরা দাবী করেছেন সরকারের শেষ সময়ের মধ্যেই এসব গ্রাম অঞ্চলের রাস্তা কালভার্ট বিদ্যুৎ উন্নয়ন করা হবে। তা না হলে প্রশ্ন যাবে। সাবেক এমপিরা গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে হিসাব নিকাশ শুরু করেছে কার আমলে কে কতো উন্নয়ন করেছে।
সিলেট সংরক্ষিত আসনের এমপি রুমা চক্রবর্তী বাড়ি বিয়ানীবাজার পৌরশহরে সুপাতলা গ্রামে। তিনি এই প্রথম নারী মহিলা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি এলাকার উন্নয়নের ভুমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1.1K বার