রাজশাহী ডেস্ক:
‘আমার চাকরির বয়স চার বছর। এমন কোনো রাত যায়নি যে, আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রেন চলে গেছে। সেটা যতই রাত হোক।’ এভাবেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন গেটকিপার শারমিন আক্তার।
গভীর রাত কিংবা দিন রাজশাহীর গোরহাঙ্গা রেলক্রসিংয়ে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন গেটকিপার শারমিন আক্তার। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে শারমিনের মতো আরও ১০ জন নারী বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ের গেটকিপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে রেলওয়ের ট্রাফিক বিভাগে দুইজন ও প্রকৌশলী বিভাগে আটজন নারী রয়েছেন। তারা আব্দুলপুর স্টেশন থেকে আমনুরা স্টেশন পর্যন্ত গেটকিপারের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের নিরলসভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দুর্ঘটনা ছাড়াই পারাপার হচ্ছে রেলক্রসিং।
চাকরির অভিজ্ঞতা নিয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় গেটকিপার শারমিন আক্তারের। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি ২০১৯ সালে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে গেটকিপার পদে যোগদান করি। আমার দেশের বাড়ি ঢাকার নারায়ণগঞ্জ। তবে আমি থাকি রাজশাহী শিরোইল কলোনিতে। রাজশাহী কলেজ থেকে ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিষয়ে অর্নাস ও মাস্টার্স করেছি। এর আগে একাদশ শ্রেণিতে লেখাপড়া চলাকালীন এই চাকরির জন্য আবেদন করেছিলাম। আমার চাকরির যোগদানপত্র আসে ওই বছরের কোনো এক বুধবারে। আর পরেরদিন বৃহস্পতিবার মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়। আমি অনেক খুশি হয়েছিলাম। একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করার সময় আমার ইচ্ছে ছিল আইনজীবী হব। কিন্তু গেটকিপারের চাকরিতে ঢোকার পর থেকে আমার স্বপ্ন লোকমাস্টার (ট্রেন চালক) হওয়ার। আমার আশা আছে। আমি হতে পারব। সেইভাবে এগিয়ে যাচ্ছি।’
নারী হওয়ায় কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই চাকরিতে যোগদানের পরে আমাকে অনেকে নানানভাবে নানান কথা শুনিয়েছে। মেয়ে মানুষ এই চাকরি করবে কীভাবে, গেটকিপারের চাকরি হাস্যকর- এমন অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমাকে। প্রথম দিকে অনেক কান্নাকাটি করেছি। সব সময় মনে করেছি ছেলেরাই যে সব কাজ পারে, তা না। আমিও এই কাজ করে দেখাব। এখন আমি এই চাকরিটি করতে পেরে খুব গর্বিত। আমিও দেশের জন্য, সমাজের জন্য কাজ করতে পারছি। আমার এই কাজটা সমাজসেবার মধ্যে পড়ে। আমি দেশের সম্পদ রক্ষা করছি। আমাকে গেটে খুব সচেতন থাকতে হয়। আমার পরিবারও যদি ফোন দেয়, আমি রিসিভ (কল ধরতে) করি না। পরে কল দিয়ে তাদের বোঝাই, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ চাকরি। ট্রেন আসার সময় হলে কারো সঙ্গে কথা বলা যায় না। যে যাই বলছে বলুক, আমার পেছনে তাকানোর সময় নাই। আমার একটাই লক্ষ্য আমার কর্মক্ষেত্রে আমি সুন্দরভাবে কাজ করব।’
রাতের বেলায় কাজ করতে সমস্যা হয় কিনা এমন কথার উত্তরে তিনি বলেন, ‘রাতের বেলা তেমন সমস্যা হয় না। এই গেটটা অনেক ব্যস্ততম গেট। যত রাতই হোক ডাউন ফেলার পর পরই দুই পাশে গাড়ির ভিড় জমে যায়। অনেক সময় বখাটেরা ইঙ্গিত করে এটা ওটা বলে। তবে আমি কিছু মনে করি না। তাদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। আমি আমার কাজটা সুন্দরভাবে ও গুছিয়ে করতে চাই।’
এই নারী গেটকিপার বলেন, ‘ট্রেন আসার সময় হলে আমাদের টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। একটা টেলিফোনের সঙ্গে এই পথের চারটা গেটকিপারের সংযোগ আছে। ফোন দিলে চারজন প্রস্তুত হয়ে যায়। প্রতিদিন স্টেশন থেকে এই কলগুলো করা হয়। টেলিফোন থেকে দুই-তিনবার কল আসে গেটকিপারদের কাছে। আমরা একবারে ফোন রিসিভ করে গেটে চলে আসি। তারপরেও ফোন দেয় আমাদের প্রস্তুত রাখার জন্য। ট্রেনের জন্য আমাদের কখনো ২০ মিনিট আবার কখনো এক ঘণ্টাও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। নারী হওয়ায় রেলগেটে কাজ করার সময়ে অনেক মানুষ তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। প্রথম অবস্থায় আমার খুব লজ্জা লাগত। পরে নিজেকে বুঝিয়েছি, আমার কাজ আমি করছি। মানুষ তো তাকাবেই। এটা কোনো ব্যাপার না। তাই এখন সেই দিকে খেয়াল করি না। এখন আমার একটাই খেয়াল, ট্রেন কখন আসবে। কিংবা হর্ন শোনা যাচ্ছে কিনা।’
এমন কি কোনো দিন গেছে আপনি বুঝতে পারেননি আর ট্রেন চলে গেছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে শারমিন বলেন, ‘আমরা যারা মেয়ে গেটকিপার আছি তাদের নাইট ডিউটিও পড়ে। আমার মাস্টার কোনোদিন বলতে পারবে না। যে রিং বেজেছে আমি রিসিভ করিনি। মাস্টার রিং দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি রিসিভ করি, গেটে চলে আসি। আমার চার বছর চাকরিতে এমন কোনো দিন যায়নি যেদিন আমি বুঝতে পারিনি আর ট্রেন চলে গেছে। সেটা যত রাতই হোক। আমি সচেতন থাকি যেন মিস হওয়ার কারণে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। কারণ আমার ওপরে ভরসা করে এই মানুষগুলো রাস্তায় চলাচল করে।’
চাকরি নিয়ে তার পরিবারের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শারমিন বলেন, ‘আমার বাবা-মা এদিক থেকে অনেক খুশি। চাকরির পর আমি যখন ভেঙে পড়েছিলাম। তখন বাবা-মা আমাকে প্রেরণা দিয়েছেন। তারা বলেছে, তুমি এগিয়ে যাও। তুমি একদিন দেখিয়ে দেবে যে তুমিও পার। শুধু ছেলেরাই পারে না তুমিও পার। প্রথম দিকে আমাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি কটু কথা শোনাত। এলাকার মানুষ বলত, তুমি এই কাজ করবে! আমার স্বামী পর্যন্ত নেগেটিভ ছিল। সে বিষয়টি মানত না। কিন্তু যখন দেখল, কাজটাই এ রকম। পরে সে বুঝেছে। এখন আর আমাদের মধ্যে চাকরি নিয়ে আর সমস্যা হয় না। আমাদের ডিউটি পরে সকাল, বিকেল ও রাতে। আমাদের এই গেটে ছয়জন কলিগ রয়েছে। একই টাইমে দুজন করে ডিউটি পরে।’
তিনি আরও বলেন, ‘স্টেশন থেকে কল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রস্তুত হয়ে যাই। আমি ট্রেন আসার আগে গেট ডাউন কিছুটা নামিয়ে রাখি। তাতে করে দ্রুত সময়ে মধ্যে ডাউন নামিয়ে দিতে পারি। শুধু এই গেটে ট্রেন পার করে দিলাম দায়িত্ব শেষ তা কিন্তু নয়। গোদাগাড়ীর কাঁকনহাট স্টেশন পর্যন্ত সাতজন গেটকিপার আছে। তাদের দ্রুত সময়ে মধ্যে ট্রেন আসার খবর জানিয়ে দেই।’
রাজশাহী রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার মো. জাহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পশ্চিম রেলওয়ের রাজশাহী রেলস্টেশনের অধীনে কাজ করেন শারমিন। শারমিন কাজের ক্ষেত্রে সব সময় প্রস্তুত থাকেন। এছাড়া গেটকিপারদের কাজে অবহেলার সুযোগ নেই। গোরহাঙ্গা রেলগেট ছাড়াও বর্ণালীর মোড় কদমতলা রেলক্রসিং, ভদ্রা রেলক্রসিং, সরদাহ রেলক্রসিংয়ে নারী গেটকিপাররা কাজ করেন। তারা ভালোই ডিউটি করেন।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার