স্টাফ রিপোর্টার:
শাহ মিজান শাফিউর রহমান। পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক। পেয়েছেন পুলিশ বাহিনীর সর্বোচ্চ পদক পিপিএম-বিপিএম। সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি ছিলেন। সিলেট থেকে তাঁর বদলির আদেশ হয়েছে সদ্য।
সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন থানার ওসিদের কাছ থেকে সরাসরি টাকা নেওয়াসহ অনেক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে ডিআইজি শাফি। এর মধ্যে রয়েছে- চিনি চোরাচালানসহ ভারত থেকে অবৈধপথে নিয়ে আসা সকল পণ্যে আছে তার ভাগবাটোয়ারা। আছে ঘুষ বাণিজ্যের নানান অভিযোগ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কেবল তার নির্দেশে সিলেট অঞ্চলে ১৮ জন নিহত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে বহু মানুষ হত্যার অভিযোগও রয়েছে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের দোসর হিসেবে টানা ১৬ বছর ক্ষমতার অপব্যবহার করে কামিয়েছেন বিপুল অর্থ। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজির ও ডিবির হারুন চক্রের যে অর্ধশতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা এখন দুদকের জালে তিনি তাদের একজন। গত ২১ আগস্ট বুধবার ডিআইজি শাহ মিজানকে ঢাকাস্থ রেলওয়ে পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক হিসেবে বদলি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এবার আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতি আর অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক মাঠে নেমেছে।
দুদক’র এক কর্মকর্তা বলেছেন, ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমানসহ দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদক প্রধান কার্যালয়ের বিশেষ টিম কাজ করছে। তাদের প্রত্যেকের পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজনদের সম্পদেরও খোঁজ খবর নিচ্ছে দুদক।
জানা গেছে, গেল ১৬ বছরে উচ্চাভিলাষী, অপেশাদার আচরণের মাধ্যমে ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিদায় নেয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ নিয়ে তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ‘অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ’ করেন। নির্দেশ দেন ছাত্র-জনতার ওপর প্রাণঘাতী গুলি করার। গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে মরণকামড় দেয়া দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে শাহ মিজান অন্যতম। দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট এসব কর্মকর্তার তালিকা প্রস্তুত করে ইতোমধ্যে মাঠে কাজ করছে। তার বিরুদ্ধে পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার ও গ্রেফতার বাণিজ্যসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছ।
সূত্র জানায়, গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রোববার সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি হিসেবে শাহ মিজান শাফিউর রহমান যোগদান করেন। সিলেটের ডিআইজির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের উপর পুলিশি নির্যাতনের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। গেল জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত ডামি সংসদ নির্বাচনে সিলেট-৫ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী রূপালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহমদ আল কবিরকে পাশ করানোর দায়িত্ব নেয় পুলিশ। বড় অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তার পক্ষে কাজ করছিলেন জকিগঞ্জ থানার তৎকালীন ওসি মো. জাবেদ মাসুদ। ওসিকে ক্লোজ করার নির্দেশ থাকলেও তা না করে তাকে অসুস্থ দেখিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরবর্তীতে তাকে বদলি করা হয় হবিগঞ্জের মাধবপুর থানায়।
গেল বছর মাধবপুর থানায় দায়িত্ব পালন করা ওসি রকিবুল ইসলামকে বাহুবল থানা থেকে প্রথমে হবিগঞ্জ পুলিশ লাইনে এবং ১৪ আগস্ট মাধবপুর থানায় বদলি করা হয়। থানা ছাড়ার সময় দুটো সরকারি এসি তিনি খুলে নিয়ে যান। এ ঘটনায় সমালোচিত হলেও ডিআইজি শাহ মিজানের আশীর্বাদে তাকে পিপিএম পদক দেয়া হয়। দুর্নীতিবাজ হওয়ার কারণে স্থানীয় জনসাধারণের বাধার মুখে ওই ওসিকে মাধবপুর ছাড়তে হয়। বর্তমানে ওই ওসি সিলেট জেলা পুলিশে রয়েছেন বলে সূত্র জানায়।
শাহ মিজান শাফিউর রহমান সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, তিনি অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হলেও ঘুষ-দুর্নীতির কোনো প্রমাণ রাখেন না তিনি। অর্থ লেনদেনও করেন নিজে। সিলেট রেঞ্জের যেসব থানা থেকে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের অর্থ আসে, সেসব থানার ওসিরা তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ওসিরা টাকা নিয়ে সরাসরি তার বাসায় ছুটে যান। সেখানে ‘ওয়ান টু ওয়ান’ লেনদেন হয়। নিজের ঘনিষ্ঠ ছাড়া অন্যদের কাছ থেকে টাকা নেন না তিনি। কেবল সিলেটের ডিআইজির দায়িত্ব পালন করেই শাহ মিজান শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
২০০১ সালে ২০তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। প্রথমে চট্টগ্রাম, পরে ঢাকা মহানগর পুলিশ ডিএমপিতে যোগ দিয়ে দলীয় ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পরবর্তীতে পুরস্কারস্বরূপ তাকে লক্ষ্মীপুরের এসপি করা হয়। লক্ষ্মীপুরে তার সময়ে বিএনপি-জামায়াতের ১১ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে তাকে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার করা হয়। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। ওই সময়ে সালমান এফ রহমানের সহযোগিতায় ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান ‘হাফিজ-নাজনীন ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলেন। ওই ফাউন্ডেশন থেকে ২০২১ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রিয়বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ। তিনি অনেক সময় ঘুষ-দুর্নীতির টাকা ওই ফাউন্ডেশন ও স্কুলের নামে নেন বলে সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটের মহানায়ক সালমান এফ রহমান তাকে দিয়ে ঢাকা জেলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের দমন-নিপীড়ন করতে থাকেন। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে হন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার। শাহ মিজান ছিলেন সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারি গ্রুপের একজন সক্রিয় পুলিশ কর্মকর্তা। ওই সময়কার ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলামের একটি চিঠি পুলিশ সদর দফতরে পাঠালে তা ফাঁস হয়ে যায়। ওই চিঠির সূত্র ধরে তৎকালীন পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ তাকে রংপুরে বদলি করেন। পরবর্তীতে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় সিটিটিসিতে যোগদান করেন। ওই সময়ে যে কোনো একটি রেঞ্জের দায়িত্বের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন শাহ মিজান।
পরবর্তীতে সালমান এফ রহমানের আনুকূল্য থাকায় সিলেটের ডিআইজি হিসেবে পোস্টিং পান শাহ মিজান। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তার সহধর্মিণী রোকেয়া খাতুনও ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা রোকেয়া খাতুন বর্তমানে ইডেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভূগোল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি রাফিউর রহমান ও সাফিকা সাইয়ারা নামের দুই সন্তানের জনক।
নাটোরের লালপুর উপজেলার মুরদহ গ্রামের বাসিন্দা শাহ মিজান শফিউর রহমান। তার পিতা প্রয়াত শিক্ষক হাফিজুর রহমান ও মা নাজনীন বেগ। শাহ মিজানেরা পাঁচ ভাই। তিনি ছাড়া অন্যরা হলেন, মো. আনিসুর রহমান, মো. হাবিবুর রহমান, আ.ফ.ম রাশিদুর রহমান ও এ.ক.এম সাইদুর রহমান।
ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান (পিপিএম-বিপিএম) সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, দুর্নীতির অভিযোগ সত্য নয়। চাকরি জীবনে স্বচ্ছতার সাথে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকালে গুলিবর্ষণ আমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হয়নি, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গুলি করা হয়েছে।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার