
স্টাফ রিপোর্টার:
সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা যাবে না-কারণ তাদের ভূমিকা শুধু নিরাপত্তায় নয়, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতায়ও গুরুত্বপূর্ণ। সামনে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন, অথচ রাজনৈতিক অঙ্গন যেন ক্রমেই তপ্ত হয়ে উঠছে। এর মধ্যেই সেনাবাহিনীর কয়েক জন আদালতে হাজির করা হয়েছে। অভিযোগ-তারা আওয়ামী লীগের আমলে গুম, খুন ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিষয়টি শুধু একটি মামলার খবর নয়; এটি গোটা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর এক নতুন বিতর্কের সূচনা করেছে।
নির্বাচনের ঠিক আগে সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হওয়ায় সেনাবাহিনীর ভেতরে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে-এ কথা আর গোপন নয়। কারণ নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অথচ ঠিক নির্বাচনের আগ মুহূর্তে তাদের একটি অংশকে বিতর্কের মুখে ফেলা অনেকে রাজনৈতিক কৌশল বলে মনে করছেন। প্রশ্ন উঠছে-এর পেছনে কি নির্বাচনকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা রয়েছে? আবার কেউ কেউ মনে করছেন, এটা এক ধরনের Election disruption strategy। কিন্তু এই বিতর্কের মূল প্রশ্নটা অন্য জায়গায়-সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সশস্ত্র বাহিনীর বিকল্প আদৌ আছে কি?
বাংলাদেশের নির্বাচনি ইতিহাসে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা সবসময়ই সংবেদনশীল। ১৯৯১, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি একটি Psychological assurance হিসেবে কাজ করেছিল। সাধারণ ভোটারদের মনে একটি নিরাপত্তাবোধ তৈরি হয় ‘সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে ভোট দিতে ভয় নেই।’
তবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেই আস্থা অনেকটা ক্ষয় হয়েছে। অনেক ভোটারই বলেছেন-সেনাবাহিনী থাকলেও তারা মাঠে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি; সবকিছু ছিল প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে। ফলে সেনাবাহিনীকে কেউ কেউ দেখেছেন Power balancing force হিসেবে।
একটি বিষয় স্পষ্ট, যে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক আস্থা কম, সেখানে সেনাবাহিনী কেবল একটি নিরাপত্তা বাহিনী নয়; তারা হয়ে ওঠে জনগণের চোখে Trust symbol.
সম্প্রতি সেনাদের বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের বিশ্লেষণ সামনে এসেছে। একদল বলছে, আইন নিজের গতিতে চলছে, যারা অপরাধে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আরেক দল বলছে, নির্বাচনের সময়সীমা ঘনিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপের অর্থ রাজনৈতিক।
সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার একটি Institutional backbone. এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের নিয়ে প্রকাশ্যে পদক্ষেপ কেবল আইনগত নয়, বরং Strategic timing-এরও ইঙ্গিত দেয়। ফলে প্রশ্ন জাগে-এর উদ্দেশ্য কি ন্যায়বিচার, না রাজনৈতিক বার্তা?
বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় সাধারণত চারটি স্তরের নিরাপত্তা থাকে-পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং সেনাবাহিনী। তবে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিই সবচেয়ে বেশি আস্থা তৈরি করে। তবুও প্রশ্ন তুলতেই হয়-এই বাহিনীর বাইরে কোনো কার্যকর বিকল্প তৈরি করা যায় নাকি?
এক. শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন: যদি নির্বাচন কমিশন প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, সাহসী ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়, তাহলে সেনাবাহিনী ছাড়াও নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এক্ষেত্রে দরকার হলো-ভোটার তালিকা হালনাগাদে স্বচ্ছতা, ইভিএম বা পেপার ব্যালট মনিটরিং, বুথ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণকারী নিয়োগ, মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটির অংশগ্রহণ।
দুই. যদি জেলা প্রশাসন, পুলিশ, আনসার ও স্থানীয় কমিউনিটি একসঙ্গে কাজ করে, তাহলে নিরাপত্তা বজায় রাখা সম্ভব। তবে এর জন্য দরকার neutral mindset, যা এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি।
তিন. যেসব দেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সীমিত, সেখানে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা তুলনামূলক বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যদি credible observer দলগুলোর উপস্থিতি থাকে, তাহলে আস্থা বাড়বে।
তবে বিকল্প ভাবা যতটা সহজ, বাস্তবে তা বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে power trust প্রায় নেই বললেই চলে। বিরোধীরা বিশ্বাস করে না নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ, সরকার বিশ্বাস করে না বিরোধীরা শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন মেনে নেবে। ফলে একমাত্র মধ্যবর্তী শক্তি হিসেবে সেনাবাহিনীই দাঁড়িয়ে যায়।
বাস্তবতা হলো-সশস্ত্র বাহিনী নিজেরাও এখন এক ধরনের image crisis-এর মুখে। যখন তাদের বিরুদ্ধে মামলা বা পরোয়ানা জারি হয়, তখন বাহিনীর সদস্যরা সেটিকে শুধু আইনি প্রক্রিয়া হিসেবে নয়, বরং সম্মানের প্রশ্ন হিসেবেও দেখেন। এতে বাহিনীর ভেতরে ক্ষোভ, হতাশা ও মানসিক বিভাজন তৈরি হয়। এটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ-কারণ, নির্বাচনের মতো বড় জাতীয় কার্যক্রমে যদি সেনাবাহিনী বিভক্ত মানসিকতায় অংশ নেয়, তাহলে প্রশাসনিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী শুধু একটি নিরাপত্তা সংস্থা নয়, তারা দেশের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রতীক। এই বাহিনীকে বিতর্কিত করা মানে পুরো রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। নির্বাচনের আগে বা পরে, সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অংশ বানানো একটি বিপজ্জনক প্রবণতা।
শেষ পর্যন্ত সত্যি একটাই- সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে কোনো সরকার শক্তিশালী হয় না, বরং রাষ্ট্রই দুর্বল হয়। তাই, সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলে রাজনৈতিক মহল থেকে সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ নয়, অংশীদার হিসেবে দেখতে হবে-যেমনটা আধুনিক গণতন্ত্রে দেখা যায়।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার