ড. মো. মফিজুর রহমান:
অষ্টাদশ শতাব্দীতে (১৭৬০-১৮২০) ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারণা পালটে যায়। আগে মনে করা হতো, একটি দেশের দ্রুত এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কৃষি খাতের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমেই একটি দেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তার প্রত্যাশিত অগ্রগতি সাধন করতে পারে। কিন্তু শিল্পবিপ্লব সেই চিরাচরিত ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে পালটে দেয়। শিল্পবিপ্লবের পর অর্থনীতিবিদগণ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেন, কৃষির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কখনো-বা দ্রুত এবং কার্যকর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। কারণ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে। আর শিল্প উৎপাদন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে। কাজেই একটি দেশের বর্ধিত জনসংখ্যার অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য কৃষি নয়, বরং শিল্পের ওপরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। একটি দেশ যদি খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে, তাহলে জনগণের চাহিদাকৃত খাদ্য আমদানির মাধ্যমেও পূরণ করা সম্ভব। অর্থনীতিবিদগণ এটা মেনে নিয়েছেন যে, কৃষি নয় একমাত্র শিল্পের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমেই একটি দেশ দ্রুত এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করতে পারে। শিল্পের ওপর গুরুত্ব প্রদানের বিষয়টি অর্থনীতিবিদগণ মেনে নিলেও তাদের মধ্যে অনেক দিন ধরেই বিতর্ক চলছিল শিল্পের স্বরূপ কেমন হবে? আমরা কি শুধু বৃহত শিল্পের ওপর জোর দেব, নাকি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেব? বিশেষ করে, যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং সর্বদা বিনিয়োগযোগ্য পুঁজির সংকটে ভোগে তারা কী করবে? তারা কি বৃহত শিল্প স্থাপন করবে, নাকি ক্ষুদ্র শিল্পের ওপর জোর দেবে? আর বৃহত শিল্প এবং ক্ষুদ্র শিল্প কি পরস্পর প্রতিপক্ষ, নাকি সহযোগী? এই জটিল প্রশ্নটি অনেক দিন ধরেই অর্থনীতিবিদদের ভাবিয়েছে। বর্তমানে অর্থনীতিবিদগণ মোটামুটি একমত যে, কোনো দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল হলে তাদের বৃহত শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের ওপরই বেশি জোর দিতে হবে। যাদের পুঁজিসংকট নেই, তারা বৃহত শিল্পে অর্থায়ন করবে। আর যারা স্বল্প পুঁজির মালিক অথবা একেবারে কম পুঁজির মালিক, তারা প্রথমে ক্ষুদ্র উদ্যোগে যুক্ত হবে। সেখান থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করার পর বৃহত শিল্প স্থাপনে উদ্যোগী হবে। আর বৃহত এবং ক্ষুদ্র শিল্পের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই বা একে অন্যের প্রতিপক্ষও নয়, বরং পরিপূরক। অনেক দেশ আছে যেখানে বৃহত শিল্পগুলো শুধু সংযোজনের দায়িত্ব পালন করে আর ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাগণ শিল্পের উপকরণ তৈরি করে। জাপানের কথা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। জাপানের টয়োটা কোম্পানি গাড়ির কোনো পার্টস নিজেরা তৈরি করে না। তারা সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের দিয়ে গাড়ির পার্টস তৈরি করে এনে নিজস্ব কারখানায় সংযোজন করে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র শিল্পগুলো বৃহত শিল্পের সহায়ক শিল্প হিসেবে কাজ করে। এতে বৃহত শিল্পের বিকাশ সহজতর হচ্ছে আর ক্ষুদ্র শিল্পগুলোও বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে, যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে তাদের শিল্পায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে। বিশেষ করে, জনসংখ্যাধিক্য একটি দেশের জন্য বৃহত শিল্পের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশ খুবই জরুরি। বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যাধিক্য দেশ। কিন্তু প্রচুর সম্ভাবনাময় একটি দেশ। বাংলাদেশের মানুষ যে কোনো কিছু একবার দেখলেই তা অনুসরণ করে নব সৃষ্টিতে মেতে উঠতে পারে। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ নানাভাবে শিল্পায়নের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে এতদিন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নের ওপর খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বর্তমান সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর এসএমই (স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) শিল্প বিকাশের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কটেজ এবং মাইক্রো ইন্ডাস্ট্রিজকে এসএমই খাতের অন্তর্ভুক্ত করে এই খাতের নতুন নামকরণ করা হয়েছে—‘কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ (সিএমএসএমই)। এর ফলে অতি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প যেগুলো একদিন প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদান কার্যক্রমের বাইরে ছিল, তারাও প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। আগে অতি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের উদ্যোক্তাদের অর্থায়নের জন্য এনজিও এবং গ্রামীণ মহাজনের কাছে ধরনা দিতে হতো।
এসএমই ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। এসএমই ফাউন্ডেশন ২০০৭ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তার যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর লগ্ন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে যে সিংগেল ডিজিট (৯ শতাংশ) সুদে ব্যাংক ঋণ দেওয়া সম্ভব, তা এসএমই ফাউন্ডেশনই প্রথম চালু করে। ২০০৯ সাল থেকে এসএমই ফাউন্ডেশন ৯ শতাংশ সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে চলেছে। সম্প্রতি এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৪ শতাংশ সুদে ছোট উদ্যোক্তাদের দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন ক্লাস্টারভিত্তিক লোন বিতরণের জন্য ১৬টি ব্যাংক ও তিনটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এসব ব্যাংক এসএমই ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ক্লাস্টার লোন বিতরণ করছে। ক্লাস্টার লোনের জন্য ৪৫০ কোটি টাকার একটি রিভলবিং ফান্ড গঠন করেছে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ক্লাস্টার লোনের ২৫ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ মোট ঋণের ২৫ শতাংশ পাবেন নারী উদ্যোক্তাগণ। উৎপাদন এবং ট্রেডিং উভয় খাতেই এই ঋণ দেওয়া হবে। তবে ট্রেডিং খাতে মোট ঋণের ২৫ শতাংশের বেশি দেওয়া যাবে না। অবশিষ্ট ৭৫ শতাংশ ঋণ দেওয়া হবে উৎপাদন খাতে। এ ঋণদান কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে তা দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য অত্যন্ত কার্যকর একটি ঋণদান কর্মসূচি হিসাবে গণ্য হবে। যদিও এটির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অতিশয় নগণ্য।
বাংলাদেশে সিএমএসএমই খাতের গুরুত্ব কেমন—এ বিষয়ে মাঝে মধ্যেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশের মতো দ্রুত বর্ধনশীল একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সিএমএসএমই খাতের কোনো বিকল্প নেই। সবার মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার গুণাবলি থাকে না। আর রাতারাতি উদ্যোক্তা সৃষ্টিও হয় না। এসএমই ফাউন্ডশন নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে সিএমএসএমই খাতের সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা দিয়ে উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। এসএমই ফাউন্ডেশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত ১০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এছাড়া ৫০ হাজার বিদ্যমান উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, এসএমই খাতের বিকাশ সব দেশের অর্থনীতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এসএমই খাত হচ্ছে একটি দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন।’ জাপানের অর্থনীতির ৯৩ শতাংশ, কোরিয়ার ৭৭ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ৬৫ শতাংশ, ভিয়েতনামের ৪৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ৪৮ শতাংশ, থাইল্যান্ডের অর্থনীতির ৪৩ শতাংশ আসে এসএমই খাত থেকে। এমনকি ভারতের অর্থনীতির ৩৮ শতাংশ আসে এসএমই খাত থেকে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ বা ২৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের মধ্যে জাতীয় অর্থনীতিতে এসএমই খাতের অবদান ৩২ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সিএমএসএমই খাতের উন্নয়নের জন্য এসএমই ফাউন্ডেশন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রতি বছর জাতীয় পর্যায়ে এসএমই পণ্য মেলার আয়োজন করা হয়। সম্প্রতি রাজধানীতে জাতীয় পর্যায়ে এসএমই পণ্য মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসএমই মেলায় মোট ৩৪০টি প্রতিষ্ঠানের ৩৫৯টি স্টল স্থান পায়। মেলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬০ শতাংশই নারী উদ্যোক্তা এবং অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ পুরুষ উদ্যোক্তা। সবচেয়ে বেশি স্টল ছিল ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর, যার সংখ্যা ১৪৪টি। জাতীয় পর্যায়ে এসএমই মেলা সফলভাবে সম্পন্ন করার পর এখন বিভাগীয় পর্যায়ে এসএমই পণ্য মেলা আয়োজন করা হচ্ছে। এসএমই মেলায় অংশগ্রহণকারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রবল আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়। এই মেলা যেন এসএমই উদ্যোক্তাদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। মেলায় অংশগ্রহণকারী উদ্যোক্তাগণ পণ্য বাজারজাতকরণের কৌশল, অন্য উদ্যোক্তাদের পণ্যের গুণমান প্রত্যক্ষ করা এবং পরস্পর মতবিনিময়ের সুযোগ পান।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাগণ বংশানুক্রমিকভাবেই উদ্যোক্তা হবার যোগ্যতাসম্পন্ন। তারা হস্তশিল্পে অত্যন্ত দক্ষ। সামান্য সহায়তা পেলেই নিজেদের উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে পারেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার যুবসমাজের উদ্দেশ্যে বলেছেন—‘তোমরা চাকরির পেছনে না ঘুরে নিজেদের উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে তোলো।’ তার এই আহ্বান যে কোনো বিবেচনায়ই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় ক্রমবর্ধমান চাকরি প্রার্থীদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা মোটেও সম্ভব নয়। তাই বিকল্প পন্থা হিসাবে তরুণদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে শুধু একজন মানুষ নিজেও স্বাবলম্বী হতে পারে এবং একই সঙ্গে অন্যদেরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এসএমই ফাউন্ডেশন, অনুলিখন: এম এ খালেক
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার