স্টাফ রিপোর্টার:
গত ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এই প্রশংসনীয় উদ্যোগের প্রথম প্রস্তাবিক সিলেটের কৃতিসন্তান, সাবেক অর্থমন্ত্রী, সিলেট-১ আসনের সাবেক সাংসদ আবুল মাল আবদুল মুহিত।
২০১৩ সালে আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য পেনশনের ধারণা দিয়েছিলেন। সরকারি কর্মকর্তাদের একটি বৈঠকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মুহিত যখন তাঁর এ ধারণার বিষয়টি তুলে ধরেন, তখন সেখানে উপস্থিত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। বলেছিলেন, স্যার, এটা সম্ভব নয়।
অর্থমন্ত্রী শান্ত হয়ে ওইসব কর্মকর্তার কথা শুনেছিলেন। সম্ভব না বলা কর্মকর্তাদের যুক্তি শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘সবার জন্য পেনশন চালু করতে পারলে এ দেশ থেকে অনেক কিছু দূর হবে। মানুষ যখন দেখবে তার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত তখন অনেকেই অনিয়ম থেকে সরে আসবে। মানুষ এত অনিয়ম-হানাহানি করে শুধু ভবিষ্যতের জন্য। আর ভবিষ্যতে বেসরকারি পেনশনের সঙ্গে সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশনও এক করে দেব। আলাদা পেনশন থাকবে না।’ অর্থমন্ত্রীর এমন মন্তব্য শুনে নীতিনির্ধারক কর্মকর্তারা আরও ভড়কে গেলেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী মুহিত সবকিছু উপেক্ষা করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কে এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া তৈরির নির্দেশ দিলেন।
কয়েক মাস পর খসড়া যখন আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে গেল তখন তিনি খুব হতাশ হলেন। অর্থমন্ত্রী অর্থবিভাগের কর্মকর্তাদের ডেকে বললেন, ‘কিচ্ছু হয়নি। তোমরা খসড়া করো।’ এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মুহিতের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে খসড়ার কাজ শুরু হলো। দেশে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালুর নেপথ্যের এ ঘটনা দেশ রূপান্তরের কাছে তুলে ধরেন শ্রম মন্ত্রণালয়ের ওই সময়ের এক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলতেন। এ দুজনের প্রত্যক্ষ চিন্তার ফল হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, আবুল মাল আবদুল মুহিত মনে করতেন সব নাগরিকের জন্য পেনশন সুবিধা চালু হলে মানুষের নিরাপত্তা বাড়বে। পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা যখন নিশ্চিত হবে, তখন মানুষ আর অন্যায় পথে এগোতে চাইবে না।
২০১৬ সালে পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের সময় আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ‘দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’ তখন তার সে কথা বক্তব্য পর্যন্তই থাকে। তবে ২০১৮ সালের বাজেট বক্তৃতায় আবারও একই বিষয় উঠে আসে। এর আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাইলট প্রকল্প হিসেবে ৫৭ জনকে এ প্রকল্পের আওতায় আনা হয়। সেই পাইলট প্রকল্পও উদ্বোধন করেছিলেন মুহিত।
কর্মজীবন শেষে সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবী হোক না কেন, দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পেনশন সুবিধা পাবেন এ চিন্তা আর এখন স্বপ্ন বা অধরা নয়। বর্তমান সরকার ‘সবার জন্য পেনশন’ স্কিম বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। আর এ স্বপ্নের মূল কারিগর ছিলেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, মুহিত ছিলেন স্বপ্নচারী মানুষ। তিনি নিজে স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসতেন। তার চিন্তা-চেতনায় সবসময় ছিল জনগণের কল্যাণ। সবার জন্য পেনশন সুবিধার প্রস্তাব করে তিনি এটির পেছনে লেগে ছিলেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় সর্বজনীন পেনশনের প্রস্তাব প্রথম তুলেছিলেন। তখন পেনশনের একটি রূপরেখা প্রণয়নের কথা বলেন তিনি।
যে স্বপ্নের কথা বলেছিলেন মুহিত, তার বাস্তবায়ন নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। সমালোচকরা বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের প্রকল্প কার্যকর করা সম্ভব নয়। এটি উচ্চাভিলাষী।
তবে এ ব্যাপারে সরকারের কাজ যে সবার অগোচরে এগিয়ে গেছে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির এক অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সেদিন সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেয় অর্থ বিভাগ।
‘সবার জন্য পেনশন’ আওয়ামী লীগ সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো বা ঘোষণাপত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি এ স্কিম সম্পর্কে একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এজন্য পাইলট প্রকল্পের কথাও বলেছিলেন। সর্বজনীন পেনশনকে মুহিত তার স্বপ্নের প্রকল্প বলেও উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তিনি এটি চূড়ান্ত করে দিয়ে যেতে পারেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও তিনি মন্ত্রিত্ব পাননি বা বার্ধক্যজনিত কারণে নেননি। এরপর পরিকল্পনাটি ঝুলে যায়। পরে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া আ হ ম মুস্তফা কামাল এ প্রকল্পটি ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেন। ধীরে হলেও এগোতে থাকে এর কার্যক্রম।
সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয় গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট)। প্রথম পর্যায়ে চার শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য চার ধরনের পেনশন কর্মসূচি চালু করা হয়েছে। এগুলোর নাম হচ্ছে প্রগতি, সুরক্ষা, সমতা ও প্রবাসী।
যুগান্তকারী এই সার্বজনিন পেনশনের পেছনের স্বপ্নদ্রষ্টাকে বাঁচিয়ে রাখবে এ কর্মসূচি। আবুল মাল আবদুল মুহিত চিরঞ্জীব থাকবেন সবার জন্য পেনশনের সুবিধার মাধ্যমেই।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সিলেট জেলা মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা আবু আহমদ আবদুল হাফিজ ও সৈয়দা শাহার বানু চৌধুরীর ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান মুহিত। স্ত্রী সৈয়দা সাবিয়া মুহিত একজন ডিজাইনার। তিন সন্তানের মধ্যে কন্যা সামিনা মুহিত ব্যাংকার ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞ। বড় ছেলে সাহেদ মুহিত বাস্তুকলাবিদ এবং ছোট ছেলে সামির মুহিত শিক্ষক।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া আবদুল মুহিত বরাবরই একজন মেধাবী মানুষ ছিলেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। পরের বছর একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এর আগে অংশ নেন ভাষা আন্দোলনে। ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৫৬ সালে আবদুল মুহিত যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। সিএসপিতে যোগ দিয়ে তিনি ওয়াশিংটন দূতাবাসে পাকিস্তানের কূটনীতিকের দায়িত্ব নেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুনে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সিএসপি হওয়ার পর মুহিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি পরিকল্পনাসচিব হন। এর আগে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপসচিব থাকাকালে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের ওপর ১৯৬৬ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন তিনি। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে এটিই ছিল এ বিষয়ে প্রথম প্রতিবেদন।
বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় তিনি পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের সদস্য হলে সেপ্টেম্বরে মুহিত হন বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা গ্রুপের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক।
১৯৭৭-৮১ পর্যন্ত অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ছিলেন তিনি এবং ১৯৮১ সালে স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৮২ সালে ২৪ মার্চ এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা দখল করলে তাঁকে অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী করার প্রস্তাব দিলে তিনি শর্ত সাপেক্ষে রাজি হন। শর্তটি ছিল নির্দলীয় সরকার গঠন করে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
এরশাদ কথা না রাখলে দুই বছরের মাথায় মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মুহিত। এরপর তিনি বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সরকার তাঁকে ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে তা দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ, জনপ্রশাসন, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক বিষয়ে মুহিত বই লিখেছেন ৪০টি।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত এ পর্যন্ত ১২টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন, যার ১০টি আওয়ামী লীগ সরকার আমলের।
৮৮ বছর বছরের প্রশংসিত এক বর্ণিল-বর্ণাঢ্য জীবন রেখে গত বছরের ৩০ এপ্রিল রাত ১২টা ৫৬ মিনিটে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 999 বার