স্টাফ রিপোর্টার:
‘নবযাত্রা’ এবং ‘জয়যাত্রা’ দৈর্ঘ্যে ৭৬ মিটার, প্রস্থে ৭ দশমিক ৬ মিটার। সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় প্রায় ১৭ নটিক্যাল মাইল এবং ডিসপ্লেসমেন্ট ১ হাজার ৬০৯ টন। টর্পেডো ও মাইন অস্ত্রে সজ্জিত এই সাবমেরিন দু’টি শত্রু জাহাজ ও সাবমেরিনে আক্রমণ করতে সক্ষম। এছাড়া সাবমেরিনগুলো শত্রু জাহাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণসহ বিশেষ যুদ্ধকালীন দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। এ ধরনের একটি সাবমেরিনের অবস্থান জানতে প্রায় ১০টা জাহাজ দরকার। এগুলো ৩০০ মিটার পর্যন্ত পানির গভীরে যেতে পারে। এর ডিসপ্লেসমেন্ট ১,৬০৯ টন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে এই দু’টি সাবমেরিন আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়।
এর মধ্যদিয়ে নতুন যুগে পদার্পণ করে বাংলাদেশ। মালিক হয় বিশ্বের ৪১তম সাবমেরিন ক্ষমতা সম্পন্ন দেশের। দ্বিমাত্রিক নৌবাহিনী উন্নীত হয় ত্রিমাত্রিক নৌবাহিনীতে। ০৩৫ জি টাইপ ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিন দু’টির নামকরণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সাবমেরিন দু’টি যুক্ত হওয়ায় দেশের বিশাল জলসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নৌবাহিনীর সার্বিক সক্ষমতা বহুলাংশে বেড়েছে। পাশাপাশি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ব্লকগুলোর নিরাপত্তাসহ সুনীল অর্থনীতির উন্নয়নে সাবমেরিন দু’টি সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
সাবমেরিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ এটিই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু কেউ যদি আক্রমণ করে, তার সমুচিত জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি সব সময় থাকবে। অনেকটা আত্মরক্ষার্থেই ডুবোজাহাজ দুটি ব্যবহৃত হবে। আন্তর্জাতিক আদালতের মামলার রায়ে মিয়ানমারের কাছ থেকে ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা এবং ভারতের কাছ থেকে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগাতে নৌ-বাহিনীকে ত্রিমাত্রিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলেছি।’
সমুদ্রে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানসহ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অধিকাংশই চলে জল পথে। এসব কাজে ডুবোজাহাজ দুটি আমাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুনমাত্রা যোগ করেছে। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নিরাপত্তা আরও সুদৃঢ় হয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা যে থেমে নেই, বরং তাতে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে তার প্রমাণ এই সাবমেরিন যুগে প্রবেশ। বিশ্বের অল্প ক’টি দেশের নৌবহরে যুক্ত রয়েছে সাবমেরিন। সে বিবেচনায় নিঃসন্দেহে বলা যায় নৌবাহিনীতে সাবমেরিন যুক্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদা বহির্বিশ্বে বেড়েছে।
শত্রুবাহিনীর জাহাজ কিংবা ডুবোজাহাজ আক্রমণ মোকাবেলায় সাবমেরিনের ভূমিকা ব্যাপক। বিমানবাহী জাহাজ বহর রক্ষা করা, অবরোধ দূরীকরণ, প্রচলিত স্থল আক্রমণ ও বিশেষ বাহিনীকে গুপ্তভাবে রক্ষণাবেক্ষণে ডুবোজাহাজর কার্যকারিতা অপরিসীম। এছাড়া সমুদ্র বিজ্ঞান, উদ্ধার তৎপরতা, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম, পরিদর্শন এবং রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধার জন্যও ডুবোজাহাজ ব্যবহার হয়।
আসি বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সীমানা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে। বঙ্গোপসাগর বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ উপসাগর। শেখ হাসিনার সরকার UNCLOS (United Nation’s Convention on Laws of Sea) বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে ১,১৮,৮১৩ বর্গকিলোমিটার জলরাশির একচ্ছত্র অধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। এটা বর্তমান বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের প্রায় সমান। এই বিশাল সুনীল জলরাশি দাপিয়ে বেড়ানোর সক্ষমতা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ছিল না। দূর সমুদ্রের নীল জলের উত্তাল তরঙ্গমালায় মধ্যে দাপিয়ে বেড়ানোর জন্য দরকার শক্তিশালী, প্রত্যয়ী, আধুনিক নৌবাহিনী। নিয়মানুযায়ী যার একদিকে থাকবে ভাসমান যুদ্ধজাহাজের বড় নৌবহর, অন্যদিকে গভীর সমুদ্রের তলদেশে সাবমেরিনের ক্লাস্টার। আরও থাকার কথা দূর পর্যবেক্ষণ শক্তিসম্পন্ন বহুমাত্রিক দক্ষতার বিমানের সারি।
এমন যুগোপযোগী পূর্ণাঙ্গ নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশেষে উদ্যোগ নেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে ত্রিমাত্রিক আধুনিক বাহিনীতে পরিণত করার। সুনীল অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সমুদ্রসীমার সুরক্ষা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমুদ্র সম্পদ যথাযথভাবে আহরণ, গভীর সমুদ্রে তেল, গ্যাস, খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
সাবমেরিন কিনতে ২০১৪ সালে চীনের সাথে চুক্তি করে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে চীনের দালিয়ান প্রদেশের লিয়াওনান শিপ ইয়ার্ডে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদের কাছে সাবমেরিন দুটি হস্তান্তর করেন দেশটির রিয়ার অ্যাডমিরাল লিউ জি ঝু।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 995 বার