স্টাফ রিপোর্টার:
দেশের আলোচিত দুই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ। বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন দপ্তরের হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার একচেটিয়া দখলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি।
সবকিছু নির্বিঘ্ন করতে নিজস্ব কর্মকর্তা বসিয়ে টেন্ডার ডকুমেন্ট পরিবর্তনের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর কাজ পাওয়ার পর প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বাড়িয়ে সরকারের বিপুল টাকা লুটের কূটকৌশলে নেমেছে তারা।
এ কাজে সরকারের কিছু অসৎ কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে। আর লুটের টাকার বড় অংশ ঠিকাদারি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে পাচারের অভিযোগও আছে প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একাধিক টিম। অনুসন্ধান টিমের সদস্যরা এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন। তবে এর আগেও তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের পৃথক টিম অনুসন্ধানে নামলেও শেষ পর্যন্ত তা আটকে যায়। দুদকের ভেতরে-বাইরে প্রভাবশালী মহলের তদবিরে ওই টিমের অনুসন্ধান প্রতিবেদন এখনো আলোর মুখ দেখেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে বেশকিছু অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য টিম গঠন করে দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করছেন অনুসন্ধান দলের সদস্যরা। সব নথিপত্র হাতে পাওয়ার পর তা পর্যালোচনা শেষে এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলা যাবে।’
দুদক সূত্রে জানা যায়, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের যোগসাজশে বাংলাদেশ রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা রেলের সব মেগা প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বড় বড় প্রকল্পের দরপত্র আহ্বানের পরই শুরু হয় এদের তৎপরতা। যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্র কিনছে, তাদের সবাইকে চাপ দিয়ে সিন্ডিকেটের ছায়াতলে আনা হচ্ছে। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে ক্যাডার বাহিনী তাকে জিম্মি করে অস্ত্রের মুখে। বাধা অতিক্রম করে কেউ টেন্ডার জমা দিতে পারলে শুরু হয় সিন্ডিকেটের কারসাজি।
তারা নিজস্ব কর্মকর্তা দিয়ে টেন্ডার ডকুমেন্ট পরিবর্তন করে দেয়। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে টেন্ডার ছিনতাইয়ের অভিযোগও আছে। তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক প্রথম অনুসন্ধানে নামে ২০১৮ সালে।
দুদকের সাবেক পরিচালক একেএম জায়েদ হোসেন খানকে টিম লিডার করে গঠিত ওই অনুসন্ধান কমিটি তমা-ম্যাক্স সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণকাজের টেন্ডার ছিনতাই এবং চীনা কোম্পানি চায়না লিমিটেডের কর্মকর্তাদের অপহরণের তথ্যপ্রমাণও পায়।
তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণে কয়েকটি দেশি-বিদেশি কোম্পানি দরপত্র ক্রয় করে। যেসব প্রতিষ্ঠান দরপত্র ক্রয় করে, তাদের সবাইকে নিয়ে তমা ও ম্যাক্স সিন্ডিকেট গঠন করে। দরপত্র কেনা সব দরদাতা প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেটে শামিল হয়। একমাত্র চায়না লিমিটেড সম্মত না হয়ে আলাদাভাবে টেন্ডার জমা দিতে যায়। চায়নিজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়। এরপর রেল ভবনের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় তাদের উদ্ধার করা হয় এবং তারা টেন্ডার জমা দেয়।’ এই অনুসন্ধান প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। মামলা হয়নি তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে। এমনকি অনুসন্ধান নিষ্পত্তিও করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছেন, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে মূল কাজ শেষ করেনি। ধীরগতিতে কাজ করে তারা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি খরচও বাড়িয়ে নিয়েছে। ফলে সরকারি কোষাগারের শত শত কোটি টাকা গচ্চা গেছে। রেলওয়ের দোহাজারী হয়ে কক্সবাজারের রামু থেকে গুনদুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ যৌথভাবে করছে তমা। ২০১০ সালে শুরু হলেও এ কাজ এখনো শেষ হয়নি। আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের কাজ ২০১৪ সালে শুরু হলেও এখনো শেষ হয়নি। সময় বাড়ানোর সঙ্গে এসব প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ও বেড়েছে। গোপালগঞ্জ থেকে খুলনা পর্যন্ত যে রেললাইন হচ্ছে, সেই কাজও পেয়েছে তমা। তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ সারা দেশে এখন রেলের কতগুলো কাজ করছে, সেই তালাশও করছে দুদক। বর্তমানে দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় রেললাইনে যে মানের পাথর ব্যবহারের কথা, তা না করে নিুমানের পাথর ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দুদকের কাছে তথ্য রয়েছে, গত এক যুগের ব্যবধানে শুধু রেল নয়, সড়ক ও জনপথ, বিআইডব্লিউটিএ, গণপূর্ত, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, ক্রীড়া পরিষদ, সিভিল এভিয়েশনসহ বিভিন্ন দপ্তরের হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছে তমা ও ম্যাক্স গ্রুপ। মগবাজার-মৌচাক উড়াল সড়ক নির্মাণে তমা কনস্ট্রাকশনের সঙ্গে সরকারের চুক্তিমূল্য ছিল ৩৪৪ কোটি টাকা। সেটা বেড়ে ৪২০ কোটি টাকা হয়েছে। অর্থাৎ চুক্তিমূলের চেয়ে সরকারের ৭৬ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে। ২০১২ সালে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও কাজ শেষ করা হয়েছে ২০১৭ সালে। খাদ্য অধিদপ্তরের অধীনে মোংলা সাইলোর নির্মাণকাজ পায় তমা কনস্ট্রাকশন। এই প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ছিল ৪৪৪ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে এই কাজ শেষ না করে তারা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। সেই সঙ্গে খরচও বাড়ে ৫৪ কোটি টাকা। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর কমপ্লেক্স নির্মাণে তমার চুক্তিমূল্য ছিল ১২৪ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত এই প্রকল্পে সরকারের খরচ হয় ১৪১ কোটি টাকা। ১৭ কোটি টাকা বেশি খরচে দুই বছরের এই প্রকল্প ছয় বছরে শেষ করেছে। এছাড়াও শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ জামালপুর প্রকল্পের আওতায় ২৭টি কাজের মধ্যে তমা কনস্ট্রাকশন একাই পায় ৮টি প্যাকেজের কাজ। এই প্রকল্পের কাজ ২০১৬ সালে শুরু হয়ে ২০১৯ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা কাজ শেষ করে ২০২১ সালে। শুরুতে এই প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল ৭১৭ কোটি টাকা। পরে ২৩৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৯৫০ কোটি টাকা করা হয়।
জানা যায়, তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদক আরেকটি কমিটি গঠন করে গত ১৫ জানুয়ারি। উপপরিচালক মোনায়েম হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটির অন্যরা হলেন সহকারী পরিচালক আশিকুর রহমান ও মো. রুহুল হক। এই কমিটি তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, প্রকল্পের কাজে নিুমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানির নামে ভুয়া এলসি খুলে বিদেশে টাকা পাচার এবং নতুন একটি ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছে। এই কমিটি ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়ে ৫ ধরনের নথিপত্র তলব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে-তমা গ্রুপ ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ প্রদানের মঞ্জুরিপত্র, ঋণ অনুমোদনের পর থেকে ব্যাংক স্টেটমেন্ট, চার্জ ডকুমেন্টের ফটোকপি, মর্টগেজ, স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের ভ্যালুয়েশন সংক্রান্ত তথ্যাদি, আইনগত মতামত এবং গ্রহীতা কর্তৃক মঞ্জুরিপত্রের গ্রহণযোগ্যতা সংক্রান্ত কপি।
দুদকের কাছে তথ্য আছে, যে কয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে ঋণ কেলেঙ্কারির ভয়াবহ তথ্য রয়েছে, এর মধ্যে নতুন একটি ব্যাংক অন্যতম। এই ব্যাংকের পরিচালক পদেও আছেন তমা ও ম্যাক্স গ্রুপের কর্ণধাররা। ব্যাংকের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে তাদের প্রভাব খাটিয়ে শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।
এদিকে একই অনুসন্ধান দল ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মো. আলমগীরসহ অন্যান্য পরিচালক ও রেলওয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে প্রকল্প খরচ বাড়ানোসংক্রান্ত অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। রেলওয়ে মহাপরিচালকের কাছে আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর প্রকল্পের ডিপিপি ও সংশোধিত ডিপিপির সত্যায়িত ফটোকপি চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে প্রকল্পের পরিচালক সাগর কৃষ্ণ, এসএম লিয়াকত আলী, মো. মোজাম্মেল হক, ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার, মো. কামরুল আহসান ও মামুনুল ইসলামের দায়িত্বকালীন প্রকল্প কাজের ডেভিয়েশন, সময় বৃদ্ধি এবং বিওকিউ-এর আইটেমভিত্তিক ডেভিয়েশন এবং এর পরিমাপের অনুমোদন সম্পর্কিত তথ্যাদির সত্যায়িত কপি চাওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যাক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মো. আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, ‘রেলওয়ের কাজ করতে যেসব মেশিন দরকার, এর কোনোটির দাম ১০০ কোটি টাকা।
এসব মেশিন আমাদের ছাড়া দেশের অন্য কোনো কোম্পানির নেই। তাই রেলের বড় কাজ অন্য কেউ করতে পারে না। দেশীয় কোনো কোম্পানি ভালো করবে, বড় হবে, এটা হয়তো কেউ কেউ চাচ্ছে না।’ প্রকল্পের কাজ ঝুলিয়ে দিয়ে সরকারি অর্থ লুটের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ করা গেলে অর্থ অপচয় কমবে, এটা ঠিক। কিন্তু মূলত প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই প্রজেক্ট নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যায় না। এজন্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা ঠিকাদারের দায় নেই।’ দুদকের নথি তলব এবং প্রাপ্ত তথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি সামান্য পরিমাণ বিচলিত নই। আমরা যে দরে আখাউড়া প্রকল্পের কাজ করছি তাতে আমাদের পদক দেওয়া উচিত। বিদেশি কোনো কোম্পানি হলে এতদিন এটা ফেলে চলে যেত।’
দুদক থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে আলাপকালে তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি সব ধরনের নিয়ম মেনেই আমরা কাজ করছি। দুদক আমাদের কাছে যে কোনো ধরনের তথ্য চাইলে সরবরাহ করা হবে। আইনিভাবে আমরা দুদকের অভিযোগ অনুসন্ধানের বিষয়টি মোকাবিলা করব।’ বক্তব্যের জন্য তমার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে দুদক থেকে প্রাপ্ত কিছু দালিলিক তথ্য এবং সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রশ্ন তার হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো হয়। তিনি সিন করলেও কোনো জবাব দেননি।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার