গাজীপুর প্রতিনিধি:
গাজীপুরের কালীগঞ্জে কর্মজীবী মা ও তাদের শিশুদের রাখার সুব্যবস্থার জন্য সরকারিভাবে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় প্রীতিলতা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। চোখ ধাঁধানো ঝকঝকে ছয়তলা ভবন, আছে স্বল্প মূল্যে নানা সুবিধা। কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত হোস্টেলটির সুফল পাচ্ছেন না কর্মজীবী মায়েরা।
ভবনটির আশপাশে নেই কোনো শিল্পকারখানা, দূর থেকে আসতে পরিবহন ভাড়া বেশি লাগায় স্বল্প আয়ের অনেক নারীই এখানে আসতে চান না। অথচ জেলার অন্যান্য শিল্প সমৃদ্ধ এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করলে এর সুফল পেতেন সাধারণ কারখানার শ্রমিকরা। এদিকে প্রকল্পের আয়েই এর ব্যয়ভার চলার কথা থাকলেও আয় তো দূরের কথা ৩২ মাস ধরে বন্ধ আছে দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা।
মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, আশপাশের শিল্পকারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের আবাসন সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রায় চার বছর আগে কালীগঞ্জের দেওপাড়া এলাকায় ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে হোস্টেলটি নির্মাণ করে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর। ভবনটিতে ১২৪ জন নারীর থাকার সুব্যবস্থা রয়েছে, পাশাপাশি শিশু দিবাযত্নে কেন্দ্রে ২০ জন শিশু থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনটির ব্যবস্থাপনার জন্য দায়িত্ব পালন করছেন ১৬ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এ হোস্টেলে চার শয্যাবিশিষ্ট একটি কক্ষে থাকতে একজন নারীর ব্যয় হবে ৫০০ টাকা। তিন শয্যার কক্ষে ৭০০ টাকা এবং দুই শয্যার কক্ষে ৯০০ টাকা দিতে হবে। বর্তমানে ১২৪ জন নারীর আসন থাকলেও কাগজপত্রে রয়েছে মাত্র ১৭ জন। এখন পর্যন্ত শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রে কোনো শিশুকে পাওয়া যায়নি।
এই কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের গেট খোলা। আশেপাশে নেই কোনো নিরাপত্তাকর্মী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে ভবনের চারপাশে নোংরা জমেছে। ভবনের ভেতরে মানুষ না থাকায় বাসা বেঁধেছে মাকড়শা। অত্যাধুনিক লিফট থাকলেও তা অকেজো পড়ে আছে। নিচতলায় মাঝের ফাঁকা জায়গায় শিশুদের জন্য পড়ে আছে বেশকিছু প্লাস্টিকের খেলনা। ক্যান্টিনে চেয়ার টেবিল থাকলেও ধুলাবালির আস্তর জমেছে। ক্যান্টিনে ব্যবহৃত ফ্রিজে রাখা মাছ-মাংসে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে হলরুমে। হোস্টেলের রুমে গিয়ে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি রুম খালি পড়ে আছে। মজবুত খাট আর দামি ম্যাট্রিক্স থাকলেও থাকার কেউ নেই। ধুলোবালি জমে নষ্ট হচ্ছে প্রতিটি বেড। অযত্ন আর অবহেলার ছাপ রয়েছে সর্বত্র।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেখানে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে এর আশপাশে শিল্পকারখানা নেই বললেই চলে। দূরে প্রাণ শিল্পকারখানার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে বেশিরভাগ শ্রমিকই স্থানীয়। আর সেখান থেকে হোস্টেলে আসতে ৩০ টাকার ওপর ভাড়াও গুণতে হয়। নানা কারণে এখন আর সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই এ ভবনটির প্রতি।
কর্মজীবী হোস্টেলের কর্মরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ভবন নির্মাণ ও উদ্বোধন করেই দায় সেরেছে অধিদপ্তর। এখানে ১২৪ জন কর্মজীবী নারীর আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে থাকছেন মাত্র ১৭ জন। ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা না থাকায় কেউ এসে বেশি দিন থাকতে পারছেন না। বিষয়গুলো কর্মকর্তাদের জানানো হলেও বরাদ্দ না থাকার অজুহাতে এড়িয়ে যান তারা। বরাদ্দ না থাকায় ৩২ মাস ধরে হোস্টেল সুপারসহ ১৬ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতনভাতাও বন্ধ রয়েছে। হোস্টেল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবে এমন কোন সরঞ্জাম নেই তাদের। তারা বাসা থেকে এসে যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করবে সেই ভাড়াও নেই তাদের কাছে।
তারা আরও জানান, তাদের চাকরি এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। অধিদপ্তর থেকে শুধু আশা দিচ্ছে যে, নতুন করে প্রকল্প পাস হলে বেতন আসবে।
প্রীতিলতা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নিয়ে মহিলা অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কালীগঞ্জে কর্মজীবী নারী হোস্টেলের প্রকল্প নেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, হোস্টেলের আয় থেকেই ব্যয় নির্বাহ করা হবে। প্রকল্প শুরুর পর হোস্টেল থেকে প্রতি মাসে গড়ে আয় হয়েছে ২০ হাজার টাকা। আর প্রতি মাসে ১৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২০ সালে শেষ হয়। এখন হোস্টেল পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে হোস্টেল সুপার ফারহানা ফরিদ বলেন, হোস্টেলে যেকোনো সমস্যা হলে আমি যাই। বরাদ্দ না থাকায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় তিন বছর যাবত আমাদের কারো কোনো বেতন নেই। হোস্টেলে যে কয়জন নারী থাকে তাদের থেকে পাওয়া টাকা আমি ব্যাংকে জমা দেই। অধিদপ্তর থেকে জানতে পেরেছি নতুন করে প্রকল্প পাস হলে আমাদের বেতন পরিশোধ করা হবে এবং হোস্টেলের পরিস্থিতি উন্নত করা হবে।
এখানে কেন অধিকাংশ আসন ফাঁকা ও কর্মজীবী নারীরা আসতে আগ্রহী হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আশপাশে শিল্পকারখানা নেই। প্রাণ-আরএফএল’র একটি প্রতিষ্ঠান আছে সেখান থেকে আসতেও পরিবহন খরচ বেশি হয়ে যায়। নানা কারণে স্বল্প আয়ের লোকজন এখানে আসছে না।
প্রকল্প পরিচালক ফারহানা আক্তার বলেন, প্রকল্প চলাকালীন আমি এই প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলাম। প্রকল্পটি শেষ হয়ে গেছে ২০২০ সালে। এখন এটা রাজস্ব থেকে চালানোর প্রক্রিয়া হচ্ছে। এটার জন্য নতুন করে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও আসন পূর্ণ করতে আমরা বিভিন্ন কারখানার সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার