দীর্ঘ যুদ্ধে ক্লান্ত গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন মাহমুদ। তার চার সন্তানের খাবারের জন্য রান্নাঘরের সামনে সকাল আটটা থেকে অপেক্ষা করছেন তিনি। পেছনে তার সন্তানরা প্লাস্টিকের বেসিন হাতে দাঁড়িয়ে আছে একটু স্যুপের আশায়। এই করুণ দৃশ্য আজ গাজার বাস্তবতা। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, খাদ্য সংকট এবং মানবিক সহায়তার অভাবে ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের জীবন পরিণত হয়েছে বেঁচে থাকার এক কঠিন সংগ্রামে।
৩৯ বছর বয়সী মাহমুদ তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রতিদিন গাজার জাবালিয়া এলাকার ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে ছুটে যান খাবারের খোঁজে। তার এই যুদ্ধ শুধু খাদ্যের জন্য নয়, জীবনের জন্য, একটু বেচে থাকার জন্য। যুদ্ধ তার জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। একটি রান্নাঘরের সামনে স্যুপের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা এখন তার প্রতিদিনের কাজ। সামান্য একটু ডালের স্যুপ পেলেই মহা খুশি তারা। সেটা দিয়েই কোনো রকমে পরিবারের তিনবেলার খাবারের চাহিদা মিটিয়ে নেন তারা। আর যেদিন কিছুই পান না, সেদিন খালি পেটে ঘুমাতে যান। পরের দিন ভোরে উঠে আবার যান ট্রাকের কাছে। শুধুমাত্র একটু স্যুপের উদ্দেশ্য।
মাহমুদ জানান, তার এক মেয়ে হৃদরোগে ভুগছে এবং তার ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমাও রয়েছে। এছাড়াও পরিবারের এক সদস্য হুইলচেয়ারে চলাফেরা করেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসা তো দূরের কথা, একটু পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কান্নাভরা চোখ নিয়ে তিনি বলেন, আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। বাবা হিসেবে নিজেকে অনেক অসহায় লাগে।
একদিন খাবার পেলেও সেটা হয় মাত্র এক প্লেট স্যুপ। সেই স্যুপ ছোট টিনের পাত্রে ঢেলে মাহমুদ তার চার সন্তান ও ভাইয়ের দুই সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দেন। তারা সবাই মাটিতে বসে ধীরে ধীরে সেই স্যুপ খায়। ক্ষুধাভরা পেটে সেই স্যুপটুকুই তারা এত তৃপ্তি নিয়ে খায় যেন এটিই তাদের শেষ খাবার।
মাহমুদ বলেন, এটা আমাদের সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার এবং রাতের খাবার। এর পর আর কিছু থাকবে না।
ইসরায়েলি বোমায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছোট্ট এক ঘরে কাটছে তাদের জীবন। ছবি: সংগৃহীত
একটি ছোট ঘরে বেঁচে থাকার গল্প
মাহমুদ এখন তার পরিবার নিয়ে একটি ছোট এক কক্ষের রুমে থাকেন। ঘরের ভেতর কোনো আসবাব নেই, শুধু একটি গদি। সন্ধ্যায় সে যখন কিছু খাবার নিয়ে ফিরে আসে, বাচ্চারা মাটিতে বসে অপেক্ষা করে। তারা চুপচাপ খায়, কেউ কিছু বলে না। যেন তারা বুঝে গেছে—এই যুদ্ধ তাদের শৈশবের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কণ্ঠও কেড়ে নিয়েছে।
মানবিক সহায়তা আটকে আছে কূটনীতির জালে
মার্চ মাসের শুরু থেকে ইসরায়েল গাজায় খাদ্য, চিকিৎসা ও জ্বালানি প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে ২.৩ মিলিয়ন মানুষের বসবাসকারী গাজায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গাজাকে ‘দুর্ভিক্ষের দ্বারপ্রান্তে’ বলে উল্লেখ করেছে। চাপের মুখে কিছু ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি পেলেও সেগুলোর বেশিরভাগই মানুষের হাতে পৌঁছায়নি। জাতিসংঘ এক বিবৃতিতে জানায়, সোমবার (১৯ মে) কিছু ট্রাক প্রবেশ করলেও মঙ্গলবার (২০ মে) রাত পর্যন্ত কোনও সাহায্য বিতরণ করা যায়নি।
খাবারের জন্য হাজারো ফিলিস্তিনির অপেক্ষা। ছবি: সংগৃহীত
যুদ্ধ ও মানবিক বিপর্যয় একসাথে
গাজায় শুধু ক্ষুধাই নয়, প্রতিদিন চলছে নতুন করে ইসরায়েলি বোমা হামলা। স্থানীয় চিকিৎসকরা জানান, মাত্র আট দিনে এই হামলায় ৫০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে ৫৩,০০০ জনেরও বেশি মানুষ। এই সংখ্যার মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও নারীও রয়েছেন।
ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের হুমকিও ইসরায়েলকে যুদ্ধ থেকে ফেরাতে পারছে না। ছবি: সংগৃহিত
আন্তর্জাতিক চাপ ও নিন্দা: যথেষ্ট নয়?
ইসরায়েলের নিকটতম মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এখন কিছুটা সমালোচনামূলক মনোভাব নিচ্ছে। ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেন বলেছে, গাজার পরিস্থিতি ‘অসহনীয়’। তবে এসব বিবৃতি ফিলিস্তিনিদের জন্য তেমন কিছু পরিবর্তন আনছে না।
ইসরায়েল বলছে, তারা সাহায্য আটকাচ্ছে যাতে তা হামাসের হাতে না পড়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সেই নীতির কারণে মাহমুদের মতো বাবারা খাদ্য সংকটে পড়ছেন, এবং অসহায় শিশুদের মুখে তুলে দেওয়ার মতো একটি রুটিও তাদের হাতে থাকছে না।
সাধারণ মানুষের ভাষ্য: ‘আমরা কিছু চাই না, শুধু বাঁচতে চাই’
রাজনৈতিক বিবৃতি, সামরিক কৌশল কিংবা কূটনৈতিক সংঘাতের বাইরে গাজার সাধারণ মানুষদের চাওয়া খুবই সাধারণ—তারা শুধু বেঁচে থাকতে চায়। মাহমুদ কিংবা তার মতো হাজার হাজার বাবার মুখে একই কথা, আমরা কিছু চাই না। শুধু একটু খাবার, একটু নিরাপত্তা চাই। যেন আমাদের সন্তানরা অন্তত ক্ষুধায় না মরে।
মাহমুদের মতো বাবাদের এই আর্তনাদ শুধু গাজার মানুষের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সংকেত। যুদ্ধ কেবল সামরিক নয়, এটি মানুষের আশা, জীবনের নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দেয়। আজ যখন বিশ্ব রাজনীতি গাজাকে ঘিরে নানান হিসেব কষছে, তখন মাহমুদের মতো একজন বাবার প্রশ্ন হলো, ‘আমার সন্তানের ক্ষুধার জন্য দায়ী কে?’ মানবতা আজ গাজার শিশুদের কান্নার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছে না। এটি সমগ্র পৃথিবীর নৈতিক ব্যর্থতায় পরিণত হয়েছে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা