Daily Jalalabadi

  সিলেট     বৃহস্পতিবার, ২৮শে আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ১৩ই ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিয়ানীবাজারের বিয়ে: অতীত-বর্তমান

admin

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৫ | ০৭:০২ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৮ আগস্ট ২০২৫ | ০৭:০২ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বিয়ানীবাজারের বিয়ে: অতীত-বর্তমান

স্টাফ রিপোর্টার:
বিয়ে নিয়ে বিয়ানীবাজার তথা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় একটি প্রবাদ বা শ্লোক এখনো প্রচলিত। সেটি হলো ‘মাইজিয়ে (মা) কইন (বলেন) বিয়া, বাপজিয়েও (বাবাও) কইন বিয়া, কুলকুলাইয়া আসি (হাসি) ওঠে গিয়া।’ বিয়ে নর-নারীর একটি সামাজিক বন্ধন। বিয়েকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দৃঢ় চুক্তি। বিয়ে বন্ধনের মাধ্যমে শুধু দুজন নর-নারী নয় দুটি সামাজিক অবস্থানের মানুষের মধ্যেও তৈরি হয় সম্পর্কের সেতুবন্ধন। পৃথিবীর সব দেশে, সব জাতিতে, সব ধর্মে বিয়ের রয়েছে আলাদা আলাদা ঐতিহ্য। আমাদের দেশে বিয়ের আয়োজন হয় সাড়ম্ভরে। আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। বিয়ানীবাজার অঞ্চলের বিয়ের রয়েছে আলাদা কৃষ্টি, আলাদা আমেজ। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বিয়ানীবাজার অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানাদি হয় সবচেয়ে বেশি আনন্দঘন পরিবেশে।

ঘটক নিয়োগ
সিলেটে ঘটকদের বলা হয় রায়বার। ঘটকরা পাত্র বা পাত্রীর ছবি ও পরিচিতি নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানানসই সম্পর্ক জোগাড় করে বিয়ের আলাপ-আলোচনার আয়োজন করতেন। ঘটকরা অনেক সময় কোনো পক্ষের কাছ থেকে কোনো অর্থ গ্রহণ করতেন না। তাঁরা সওয়াবের উদ্দেশেই মূলত জোড়া লাগানোর কাজ করতেন। অনেকে শখের বশেই করতেন বিয়ের ঘটকালি। বর্তমানে ঘটকালি পেশায় পরিণত হয়েছে। সত্যমিথ্যার মিশ্রণে বিয়ে লাগালেই ঘটককে গুণতে হচ্ছে টাকা। পাত্র-পাত্রী বাছাইয়ের পর উভয় পক্ষের সম্মতিতে কনের বাড়িতে চলত কনে দেখা ও পছন্দের কাজ। কনেপক্ষের বাড়িতে পাত্রপক্ষ নিয়ে যেত রসগোল্লা। পাত্রের মা, বাবা, ভাই, ভাবি গিয়ে কনে দেখে পছন্দ হলে নগদ টাকা দিয়ে পছন্দের কথা জানাতেন। তারপর বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করার জন্য পাত্রীপক্ষকে পাত্রের বাড়িতে দাওয়াত (আমন্ত্রণ) দিত। আর পাত্রী পছন্দ না হলে বলে আসত ‘বুঝিয়া জানাইমু’ (বুঝে জানাব)। এখন পাত্র-পাত্রী দেখা চলে কোনো হোটেল, রেস্টুরেন্ট বা শপিং মলে। কখনো কখনো এ যুগের ঘটকের মাধ্যমে দর-কষাকষির পর একপক্ষের সঙ্গে অপরপক্ষের মিল করিয়ে দেন ঘটকরা। অনেক সময় ইন্টারনেটে চলে পাত্র-পাত্রী বাছাই। চূড়ান্ত হলে দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়। তখন হবু বর ও হবু কনে একান্তে নিজেদের সম্পর্কে জানাশোনার কাজটিও সেরে ফেলেন। উভয় পক্ষের পছন্দের পর পারিবারিকভাবে আলাপ-আলোচনা হয় মহাধুমধামের সঙ্গে।

চিনি-পান
পাত্র-পাত্রী পছন্দ হওয়ার পর বিয়ের তারিখ ও লেনদেন ঠিক করতে কনের বাড়িতে বরপক্ষের মুরব্বিরা গমন করেন। ওই দিন কনেপক্ষের মুরব্বিরাও বাড়িতে উপস্থিত থাকেন। উভয় পক্ষের মুরব্বি ও আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে বিয়ের মোহরানা, লেনদেন, বিয়ে অনুষ্ঠান ও আকদের তারিখ নির্ধারিত হয়। এ অনুষ্ঠানকে বলা হয় চিনি-পান। আগেকার দিনে বরপক্ষ সাধ্য অনুযায়ী গরুর দুধ, পান ও চিনি নিয়ে কনেপক্ষের বাড়িতে যেত। এই তিনটি পদ নিয়ে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ যুগে এটা শুধুই স্মৃতি। এখনো এ অনুষ্ঠানের নাম পান-চিনি; কিন্তু বরপক্ষ মিষ্টি-নিমকি নিয়ে যায়।

গায়েহলুদ
বিয়ের আগের দিন সাধারণত গায়েহলুদ অনুষ্ঠান হয় বর ও কনের বাড়িতে। বিয়ের চেয়ে এ অনুষ্ঠানে ধুমধাম কম হয় না। আগে বিয়ানীবাজার অঞ্চলে গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে অবশ্যই নৃত্যগীতের আয়োজন করা হতো। হলুদের মঞ্চ মাঝে রেখে নারী শিল্পীরা গান করতেন । এখনকার গায়েহলুদ অনুষ্ঠান আধুনিক দেশি-বিদেশি গানে মুখর থাকে।

বিয়ে অনুষ্ঠান
বিয়ের নির্ধারিত তারিখের আগে থেকেই উভয় পক্ষের বাড়িতে জমকালো গেট স্থাপন করে বিয়ের প্রহর গোনা শুরু হয়। বরপক্ষ কনের সাজসজ্জার দ্রব্যাদি পাঠিয়ে দেয় আগেই। আলোকসজ্জা করা হয় দুই বাড়িতেই। আগেকার দিনে কলাগাছ ও রংবেরঙের কাগজ দিয়ে গেট সাজানো হতো। বিয়ের দিন বরের বাড়িতে নিয়ে আসা হতো নাপিত। বরের বাড়িতে নাপিত চাটাইয়ের (সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় চাটাইকে আদি বলা হয়) ওপর বসে বরের চুল-দাড়ি কাটত। পরে গোসল শেষে মায়ের হাতে এক গ্লাস দুধ পান করে বর মুরব্বিদের নিয়ে পালকি, গরুর গাড়ি বা নৌকায় চড়ে যাত্রা শুরু করতেন। মাইকে বাজত আঞ্চলিক গান। যাত্রা শুরুর আগে বরের বাড়ির মহিলারা গেয়ে উঠতেন ‘সিলেটিয়া রঙিলা দামান যাইতা শ্বশুর বাড়িগো, বিয়ার গীত গাওগো, পানের বাটা লওগো, তাড়াতাড়ি আওগো।’ এ দিন উভয় পক্ষ (বর ও কনেপক্ষ) ‘ভক্তি উপহার’ নামে একটি লিফলেট প্রকাশ করত। লিফলেটে নানা উপদেশমূলক কথা ছাড়াও ছড়া ও কবিতা লেখা থাকত। বিয়ের দিনে কনের পিতা বা অভিভাবক গ্রামের মুরব্বিদের দাওয়াত দিতেন ‘অমুক তারিখে আমার বাড়িত আইয়া (এসে) পান-তামুক খাইতা আর নওশা তুলতা।’ মানে অমুক তারিখে আমার বাড়িতে এসে পান-সিগারেট খেয়ে জামাই ঘরে তুলে দিয়েন। এখন সে প্রচলন আর নেই। এখন বর যাত্রা হয় গাড়িতে করে। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না বললেই চলে, হয় কমিউনিটি সেন্টারে। আগে বিয়ানীবাজার অঞ্চলের সব বিয়েতে প্রথমে আকদ অনুষ্ঠান হতো। আকদের পর বর পক্ষকে আপ্যায়ন করা হয়।

ফিরা যাত্রা বা আড়াইয়া
বিয়ে অনুষ্ঠানের পর বরের বাড়িতে হয় বউভাত বা ওয়ালিমা। তারপর বর কনেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যায়। সেখানে আড়াই দিন থাকতে হতো। বরের শ্বশুরবাড়িতে সে যাত্রাকে স্থানীয় ভাষায় ফিরাযাত্রা বলা হয়। আগেকার দিনে শ্বশুরবাড়িতে আড়াই দিন বর অবস্থানকালে ভুলক্রমেও বরকে মাছ দিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হতো না। দেওয়া হতো মোরগের মাংস। গ্রামের ছোট শিশুরা এ নিয়ে ‘ঝিঙ্গার ফুল ফুটিছে/দামান (বর) আইয়া উঠিছে/কইন্যার (কনে) মা নিগো ঘরো/মুরগার টেঙ্গে (পায়ে) ধরো/মুরগায় দিল ফাল (লাফ)/খায়লায়নিরে (খাইছনি) বৈরাতির (বর যাত্রী) পাল’—এমন মজার মজার ছড়া কাটত। এখনো কিন্তু আড়াই দিনের যাত্রা অব্যাহত আছে। আড়াই দিন শ্বশুরবাড়ি কাটিয়ে নতুন বর নতুন স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যান নিজের বাড়িতে। শুরু হয় নবদম্পতির সংসারধর্ম।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার

শেয়ার করুন