স্টাফ রিপোর্টার:
নানা নাটকীয়তার পর এবারের নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলেও সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যেন নাটকীয়তা কোনোভাবেই শেষ হচ্ছে না। ভোটের মাত্র কয়েক দিন আগে দলটির ক্ষোভ ও হতাশার চিত্র সামনে আসছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এই তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খোদ দলীয় প্রধান জিএম কাদের জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে এলেও শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না তা এখনো বলা যাচ্ছে না।
দর কষাকষির পর এবারের নির্বাচনেও গতবারের সমপরিমাণ ২৬টি আসনে জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে এর মধ্যে অন্তত ১৬টি আসনে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগের নেতা। ক্ষমতাসীন দল নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের ভোটের মাঠ থেকে সরালেও তাদের ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। এতে জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে আসা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২৬টি আসনের মধ্যে কতটিতে শেষ পর্যন্ত বিজয়ের মুখ দেখা সম্ভব হবে সেটা নিয়ে পার্টির মধ্যে রয়েছে সংশয়।
অনেক সময় অনেক প্রার্থী নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত থাকেন না। এ ক্ষেত্রে কেউ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, আবার কেউ এমনিতেই চলে যান। যারা নির্বাচন করতে চান না, আমি তো তাদের জোর করে করাব না। এটা তাদের অধিকার।
জিএম কাদের, চেয়ারম্যান, জাপা
এদিকে ২৬টি আসনে সমঝোতা হলেও বাকি আসনে কোনো সমঝোতা হয়নি। কয়েকটি বাদে দেশের প্রায় সব আসনেই লাঙ্গল প্রতীকে মনোনয়নও দিয়েছে জাতীয় পার্টি। তবে অন্য প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। তাদের দাবি, ২৬টিতে সমঝোতা হলে আমাদের কী দোষ। আমরা এই তালিকায় নেই কেন। এছাড়া দলীয় কোনো নির্দেশনা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা। তারা বলছেন, শীর্ষ তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না।
গতকাল রোববার (৩১ ডিসেম্বর) দেশের পাঁচটি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। সোমবারও (১ ডিসেম্বর) দেশের দুটি আসনে লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীরা ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে জাতীয় পার্টির ২০ জনের বেশি প্রার্থী ভোটের লড়াই থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। এই তালিকা নির্বাচনের আগে আরও দীর্ঘ হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্র।
জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে যে ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ তা এখন প্রকাশ্যে আসা শুরু হয়েছে। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং ঢাকার একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সফিকুল ইসলাম সেন্টু প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘জিএম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ- এই তিনজন মিলে বেইমানি করেছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করে ব্যক্তিস্বার্থে দল ধ্বংস করে দিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে তারা নির্বাচন করছেন। এখন কারও কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না।’
অবশ্য হতাশার ছাপ ফুটে উঠেছে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের কথায়ও। সোমবার রংপুরে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি না, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।
লাঙ্গলের প্রার্থীদের ভোট বর্জন বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জিএম কাদের বলেন, ‘অনেক সময় অনেক প্রার্থী নির্বাচনের শেষ পর্যন্ত থাকেন না। এ ক্ষেত্রে কেউ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন, আবার কেউ এমনিতেই চলে যান। যারা নির্বাচন করতে চান না, আমি তো তাদের জোর করে করাব না। এটা তাদের অধিকার।’
জাপা চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রার্থিতা প্রত্যাহার হুমকির কারণেও হতে পারে, অর্থের অভাবেও হতে পারে। অনেক প্রার্থী অর্থশালী নন। ফলে অর্থের কারণেও অনেকে নির্বাচন থেকে সরে যান।’
জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে জিএম কাদের বলেন, ‘নির্বাচন না আসা পর্যন্ত আমরা এই মুহূর্তে এটা বলতে পারছি না। তা সময়ই বলে দেবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।’
সরে দাঁড়ালেন আরও দুই প্রার্থী
সোমবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন জাতীয় পার্টির অন্তত দুইজন প্রার্থী। তারা হলেন চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের প্রার্থী সোহরাব হোসেন এবং হবিগঞ্জ-২ আসনের প্রার্থী শংকর পাল।
জাতীয় পার্টির নেতাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে সোহরাব হোসেন রাজনীতি ছাড়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, কোটি কোটি টাকা নিয়ে যারা মাঠে নেমেছেন তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করার সামর্থ্য আমার নেই।
জিএম কাদের, মুজিবুল হক চুন্নু ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ- এই তিনজন মিলে বেইমানি করেছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে প্রতারণা করে ব্যক্তিস্বার্থে দল ধ্বংস করে দিয়েছেন। সরকারের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে তারা নির্বাচন করছেন। এখন কারও কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না।
সফিকুল ইসলাম সেন্টু, প্রেসিডিয়াম সদস্য, জাপা
সোহরাব হোসেন বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে তিন প্রার্থী কোটি কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছেন। তারা ভোটের মাঠে কোটি কোটি টাকা ছড়াচ্ছেন। তাদের সঙ্গে আামি পেরে দিচ্ছি না। প্রতিদিন নির্বাচনী এলাকায় যখন প্রচারে নামি আমার কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। আমি কোথায় পাব এত টাকা। আমাদের নেতারা কোনো খোঁজখবর রাখেন না। মজিবুল হক চুন্নু ও জিএম কাদের মোবাইল বন্ধ করে রাখেন। তারা তাদের নিজ নিজ স্বার্থে বিভোর। আমাদের বা দলের কথা তারা ভাবছেন না। তাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালাম। একই সঙ্গে রাজনীতিও আর করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
হবিগঞ্জ-২ আসনের (বানিয়াচং-আজমিরিগঞ্জ) জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী শংকর পাল নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বলেন, নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব রয়েছে। আছে ক্ষমতাসীনদের পেশিশক্তির প্রভাব। দেশের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে সংঘর্ষ-সংঘাত চলছে তাতে নিজের ও সমর্থকদের জানমাল রক্ষা করা কঠিন। তাই বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জে প্রচারণা থেকে বিরত রয়েছি।
জাতীয় পার্টির প্রার্থী বলেন, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ ও তার গড়া জাতীয় পার্টিকে ভালোবাসি বলে এখনও দল করি। জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থিত পোস্টার ছাপিয়ে ভোট চাওয়ার লোক আমি নই। তাহলে দলের অবস্থান কোথায় থাকলো? আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোট পাওয়া যাবে না।
জাপার নেতা বলেন, গত নির্বাচনে আমার এজেন্টকে নানাভাবে নাজেহাল করা হয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই দোকান থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এর জবাব আজও পাইনি। এবারের নির্বাচনেও যে তা হবে না এর নিশ্চিয়তা কোথায়?
এর আগে গতকাল সোমবার এক দিনে গাজীপুরের দুটি, বরিশালের একটি এবং বরগুনার একটি আসনে লাঙ্গলের প্রার্থীরা ভোট থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। এর মধ্যে দুইজন দুটি করে আসনে নির্বাচন করছিলেন এবং তারা জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার