কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়:
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) হলের সিট বরাদ্দ নিয়ে প্রভোস্টকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ হাসিনা হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী ফাইজা মেহজাবিনের বিরুদ্ধে।
তিনি শেখ হাসিনা হল প্রভোস্ট সাহেদুর রহমানকে হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘এই হল আমার, আমার কথাতেই হল চলবে। যাকে যেখানে খুশি সিট বরাদ্দ দেব। আপনাকে এই হলের দায়িত্ব কে দিয়েছে?’
শনিবার (৪ মার্চ) সন্ধ্যার দিকে শেখ হাসিনা হলের এক শিক্ষার্থীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে হল পরিদর্শনে যান প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান। সমস্যা সমাধানে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী ফাইজার সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি এমন মন্তব্য করেন বলে জানা গেছে।
ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা হলের ২১৪ নম্বর রুমের আবাসিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগের ১২ তম আবর্তনের প্রেয়শী সানা রুম পরিবর্তন করার জন্য হল প্রভোস্ট বরাবর আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে ২১৬ নম্বর রুমের একটি সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়।
কিন্তু তিনি দেখতে পান তার বরাদ্দকৃত রুমে আরেকজন শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। বিষয়টি সমাধানে হল প্রভোস্টকে ফোন দেন তিনি। প্রভোস্ট এসে জানতে পারেন ওই শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেত্রী ফাইজার কথায় রুমটিতে অবস্থান করছেন। এ ব্যাপারে লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী ও হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি কাজী ফাইজা মেহজাবিনকে জিজ্ঞেস করলে, প্রভোস্টের সঙ্গে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ নেত্রী ফাইজার এমন আচরণ নতুন কিছু না। সে একজন শিক্ষক সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে পারে তাহলে ভাবুন আমাদের সাথে কি ধরনের আচরণ করে থাকে? প্রতিদিন সকাল বেলা তার চিৎকার চেঁচামেচিতে আমাদের ঘুম ভাঙে। হলে অবস্থানরত সকল শিক্ষার্থী তার প্রতি বিরক্ত। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারে না।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা শেখ হাসিনা হলের হাউজ টিউটর আল আমিন বলেছেন, ‘হল প্রভোস্টের সঙ্গে ফাইজার আচরণ শিক্ষার্থী সুলভ নয়।’
তবে হুমকি দেওয়া এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেত্রী কাজী ফাইজা মেহজাবিন। তিনি বলেছেন, ‘স্যারকে এই ধরনের কোনো কথা বলিনি। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম এই হল তো আমারও।’
এ ব্যাপারে হল প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান বলেছেন, ‘হলে কোন শিক্ষার্থী উঠবে আর কোন শিক্ষার্থী উঠবে না, এই এখতিয়ার সম্পূর্ণ হল প্রশাসনের। একজন শিক্ষার্থী তো এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যে হল সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি, তা শুধুমাত্র সম্ভব হচ্ছে না ফাইজার জন্য।’
গত বছরের ৩১ জুলাই শেখ হাসিনা হলের উদ্বোধন করা হয়। এটি উদ্বোধনের পর থেকেই সেখানে স্বেচ্ছাচারিতা এবং প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে ফাইজার বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর এক শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘আমাদের হল প্রশাসন সিট দিয়েছে। কিন্তু ফাইজার কথা হচ্ছে সেই সিট বাঁচিয়ে রাখতে গেলে নাকি ছাত্রলীগ করতে হবে! যারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত না তাদের সিট নিয়ে সে বরাবর ঝামেলা করে।’
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম আবর্তনের কোন শিক্ষার্থীকে শেখ হাসিনা হল প্রশাসন সিট বরাদ্দ দেয়নি। কিন্তু কাজী ফাইজা মেহজাবিন ১৬ তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের জোর করে হলে তুলছেন এবং অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সিট ভাগভাগি করতে বাধ্য করছেন। এমনকি জোর করে হল থেকে শিক্ষার্থীদের উচ্ছেদ চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে শেখ হাসিনা হলে নিজ উদ্যোগে কথিত গণরুম বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।
জোর করে হল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ করে এক শিক্ষার্থী বলেছেন, ‘আমি চার থেকে পাঁচদিনের জন্য বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমাকে ফোন দিয়ে বলে হলে না আসলে নাকি আমার সিট বাতিল করে দিবে। আমার সিট বাতিল করার সে কে? সেও শিক্ষার্থী, আমিও শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে হল প্রসাশনের সাথে কথা বলে আমি আমার সিট বহাল রেখেছি।’
এসব অভিযোগও অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ নেত্রী ফাইজা মেহজাবিন। তিনি বলেছেন, ‘আমি এরকম কিছুই করি নাই। হলের সিটে এলটমেন্ট (বরাদ্দ) তো আমি দেই না। হলে প্রশাসন দেয়। আমাদের হলে অবৈধ কিছু হয় না।’
হল প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনা হলে ওঠার জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের জন্য যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি নির্ধারণ করা হয়েছিল। সে ফিও দেননি মেহজাবিন।
এ ব্যাপারে হল প্রভোস্ট মো. সাহেদুর রহমান বলেছেন, ‘সবাই ফি দিলেও সে হল প্রশাসনকে এই টাকা বুঝিয়ে দেয়নি। আমি বেশ কয়েকবার বলেছি কিন্তু সে নানা অজুহাতে দেখায়। নিয়ম অনুযায়ী তার সিট বাতিল হওয়ার কথা। আমি তার সাথে এই ব্যাপারে সামনে কথা বলবো। হল প্রশাসনকে টাকা বুঝিয়ে না দিলে আমি তার সিট বাতিল করার প্রক্রিয়ার দিকে আগাব।’
সার্বিক অভিযোগের ব্যাপারে হল প্রভোস্ট সাহেদুর রহমান বলেছেন, ‘অনেক মেয়ে নানা সময় ফাইজাকে নিয়ে আমাকে অভিযোগ করেছে। তখন মেয়েদের আমি বুঝিয়েছি লিখিত অভিযোগ দিলে আমার ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়। কিন্তু মেয়েরা এখানে পড়তে এসেছে। তাদের পরবর্তী সময়ে অসুবিধার কথা চিন্তা করে আর কোন অভিযোগ করেনি। তাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও ব্যবস্থা নিতে পারিনি।’
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইলিয়াস হোসেন সবুজ বলেছেন, ‘এখানে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আছে। প্রভোস্ট স্যারও নাকি ছাত্রলীগ সম্পর্কে বাজে কথা বলেছেন। এখানে দুইজনের দুই রকমের বক্তব্য শুনছি। আমরা তদন্ত করে দেখব এবং যদি ফাইজা এমন কিছু বলে থাকে তাহলে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব। হল ছাত্রলীগের না, হল প্রশাসনের; প্রশাসনই হল চালাবে।’
ছাত্রলীগ নেত্রী ও প্রভোস্টের ঝামেলার বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈন বলেছেন, ‘হল চালাবে প্রশাসন। শিক্ষার্থীরা এখানে আসবে কেন? আমি বিষয়টা অবগত হয়েছি। বিষয়টা আলোচনা করে দেখব।’
উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা হল ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথেও খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে কাজী ফাইজা মেহজাবিনের বিরুদ্ধে। জানা গেছে, গত বছরের ৯ নভেম্বর বাসে সিট রাখাকে কেন্দ্র করে এক শিক্ষার্থীকে চড় দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে সেই শিক্ষার্থীর কাছে ক্ষমা চেয়ে ছাড় পান মেহজাবিন।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 998 বার