Daily Jalalabadi

  সিলেট     সোমবার, ১৮ই নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিয়ানীবাজারে দুই কিশোর ভাষা সৈনিকের অজানা কথা

admin

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:০০ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০৮:০০ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
বিয়ানীবাজারে দুই কিশোর ভাষা সৈনিকের অজানা কথা

স্টাফ রিপোর্টার:

ভাষা আন্দোলনের প্রবল ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছিল বিয়ানীবাজারের মাটিতেও। আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এ উপজেলা ছিল বরাবরই ছিল স্বতন্ত্র, কিছুটা ভিন্ন। ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাল ঢেউয়ে স্থির মনোবলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন বিয়ানীবাজারের কিশোর ভাষাসৈনিক ফখরুদ্দৌলা তাপাদার ও আজিজ আহমদ চৌধুরী আনা মিঞা।

ফখরুদ্দৌলা তাপাদার ২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ সালে বিয়ানীবাজার থানার মুল্লাপুর ইউনিয়নের মুল্লাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আলহাজ্ব মৌলানা মছদ্দর আলী তাপাদার ও মাতা মরহুমা ময়মুননেছা বেগমের ১৪ জন পুত্র-কন্যার মধ্যে ফখরুদ্দৌলা ছিলেন দ্বিতীয়। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৪৮ থেকেই এবং পর্যায়ক্রমে ১৯৫২’র ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার লক্ষ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রদের পাশাপাশি মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ছাত্ররাও এগিয়ে আসে। স্কুল ছাত্রদের মধ্যে রাজা জি.সি.হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র ফখরুদ্দৌলা তাপাদার ও একই শ্রেণির ছাত্র আজিজ আহমদ চৌধুরী নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন।

আজিজ আহমদ চৌধুরী ও ফখরুদ্দৌলা তাপাদারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আজিজ আহমদ চৌধুরী ১৯৩৭ সালের ৫ আগস্ট সিলেটের জকিগঞ্জ থানার (সাবেক করিমগঞ্জ) ঐতিহাসিক বীরশ্রী বাঘেরসাঙ্গন গ্রামের সুপ্রসিদ্ধ জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আলহাজ্ব নজিব আলী চৌধুরী ও মাতা মরহুমা বদরুননেছা চৌধুরীর চার সন্তানের মধ্যে আজিজ আহমদ চৌধুরী ছিলেন সবার বড়। পরবর্তীকালে তাঁর পিতা তাঁদের বিয়ানীবাজারস্থ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত কাদিমলিক গ্রামের কাছারি বাড়িকে বসতবাড়ি বানিয়ে সেখানে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হন। বয়সে ছোট হওয়ায় ফখরুদ্দৌলা তাপদারকে আজিজ আহমদ চৌধুরী দৌলা ভাই বলে ডাকতেন। ফখরুদ্দৌলা ১৯৪৮ সাল থেকেই ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় নানাভাবে সরকারি হয়রানির শিকার হন। এজন্য তিনি পড়াশুনায় খানিকটা পিছিয়ে পড়েন এবং যদিও তিনি ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সময় যুবক ছিলেন কিন্তু স্কুলছাত্র হওয়ার কারণে তাঁকে কিশোর ভাষাসৈনিক হিসেবেই সবাই জেনে এসেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ফখরুদ্দৌলা রাজা জি.সি. হাইস্কুলের ছাত্র হিসেবে ইতোপূর্বে কয়েকবার মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিলেও রাজনৈতিক কারণে ব্যর্থ হন। অবশেষে সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। একই সাথে কম্পাউন্ডারি পরীক্ষা দিয়েও সফল হন। আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি রাজা জি.সি. হাইস্কুলের ছাত্র হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন।

তখন, ২১শে ফেব্রুয়ারির আগেই সিনিয়র নেতাদের সহযোগিতায় গঠিত হলো ‘সিলেট জেলা মাধ্যমিক স্কুল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি।’ বৃহত্তর ‘সিলেট জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’র আহ্বায়ক পীর হাবিবুর রহমান দু’জনকেই ভালোবাসতেন। তিনি সিনিয়র হিসেবে ফখরুদ্দৌলাকে সভাপতি করতে চাইলে ফখরুদ্দৌলা স্বেচ্ছায় অনুজপ্রতীম আজিজ আহমদ চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেন। কারণ, আজিজ আহমদ চৌধুরী নবীন হলেও তুখোড় বক্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তাই শেষপর্যন্ত আজিজ আহমদ চৌধুরীকেই উক্ত ‘সিলেট জেলা মাধ্যমিক স্কুল রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’র সভাপতি মনোনীত করা হয় এবং সম্পাদক মনোনীত হন ফখরুদ্দৌলা স্বয়ং।

 

ফখরুদ্দৌলা তাপাদার ও আজিজ আহমদ চৌধুরী সিলেটের বিভিন্ন থানার মাধ্যমিক স্কুলসমূহে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছুটে বেড়ান ও ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিকে বাস্তবায়নে ছাত্র-ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। ১১ ফেব্রুয়ারি বড়লেখা থানার পিসি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে বক্তৃতা দানকালে পুলিশ কর্তৃক আজিজ আহমদ চৌধুরী ও ফখরুদ্দৌলা গ্রেফতার হয়ে থানা-হাজতে যান এবং পরদিন মৌলভীবাজারের সিনিয়র ভাষাসৈনিক মৌলভী আবদুল আজিজের হস্তক্ষেপে তাঁরা থানা-হাজত থেকে মুক্তি পান। তারপর বিভিন্ন অঞ্চলে গোপনে গোপনে প্রচারকার্য চালিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি তাঁরা নিজ নিজ বিদ্যালয়ে ফিরে যান।

 

২১ ফেব্রুয়ারি তাঁরা নিজ নিজ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে অবস্থান করেন। দুপুরের পর আজিজ আহমদ চৌধুরী নিজ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার এক সমাবেশে বিপ্লবী বক্তৃতা দেন। এই দিন বিকেলে ঢাকায় ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক প্রমুখ শহীদ হন। এর প্রতিবাদে পরদিন বিকেল ৪টায় সিলেটের গোবিন্দচরণ পার্কে এক সভায় ফখরুদ্দৌলা তাপাদার ও আজিজ আহমদ চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন। এই সভাতে আজিজ আহমদ চৌধুরী অগ্নিঝরা ভাষণ দেন।

২১ ফেব্রুয়ারির গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২০-২৫ দিন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে ধর্মঘট হয়। আজিজ আহমদ চৌধুরী ও ফখরুদ্দৌলার নির্দেশে সিলেট সদর, ঢাকাদক্ষিণ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, জকিগঞ্জ, বড়লেখা, বিশ্বনাথ, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলের মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্ররা ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ সপ্তাহ কালো ব্যাজ ধারণ করে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে।

বিপ্লবী কিশোর ভাষাসৈনিক ফখরুদ্দৌলা তাপাদার ও আজিজ আহমদ চৌধুরী আনা মিঞা যেমন ভাষার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, তেমনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েও নিজেদেরকে মেলে ধরেছেন জাতির জন্যে – জাতির মুক্তির জন্যে।

 

এদিকে ভাষা আন্দোলনে বিয়ানীবাজারের এই দুই কৃতি সৈনিকের কথা স্মরণ করেনা স্থানীয়রা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বেশ ঘটা করে পালন করলেও ভাষাসৈনিক ফখরুদ্দৌলা তাপাদার ও আজিজ আহমদ চৌধুরী আনা মিঞার স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতল গহবরে। তাদের নিজ গ্রামেও কেউ তাদের স্মরণ করেনা। তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে উপজেলার কোথাও নির্মাণ করা হয়নি কোন স্মৃতিস্তম্ভ। এ যেন নিজ গৃহে পরবাসী দুই ভাষা যোদ্ধা।

 

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 999 বার

শেয়ার করুন