স্টাফ রিপোর্টার:
সারা বিশ্বে শকুনকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ আন্তজার্তিক শকুন সচেতনতা দিবস পালিত হয়ে থাকে। শকুন যার ইংরেজী নাম Vulture। তীর দৃষ্টির অধিকারী এটি শিকারী পাখি। প্রকৃতিগতভাবে মৃত প্রাণির দেহ ও আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বর্জভূক এই প্রাণিটি। কিন্তু প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসাবে পরিচিত পরিবেশ রক্ষাকারী এই পাখি শকুন মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে। সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুর প্রভুতি বিশালাকার গাছে এরা বাসা বাঁধে। গুহায়, গাছের কোটরে বা পর্বতের চুড়ায় এটি ডিম পাড়ে। পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতি শকুন রয়েছে। বাংলাদেশে শুধুমাত্র ৬ প্রজাতির শকুনের মধ্যে বাংলা শকুনটি-ই কোনমতে টিকে আছে। দেশীয় প্রজাতির বাংলা শকুন ইংরেজী নাম White-rumped vulture।
সারা বিশ্বে প্রায় ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়, এর মধ্যে পশ্চিম গোলার্ধে ৭ প্রজাতির এবং পূর্ব গোলার্ধে (ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া) ঈগলের সাথে সম্পর্কিত ১১ প্রজাতির শকুন দেখা যায়। দক্ষিন এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে প্রায় ৬ প্রজাতির শকুন রয়েছে, এর মধ্যে ৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। শকুন বা বাংলা শকুন ছাড়াও এতে রয়েছে রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন-হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। তবে (পরিপ্রেক্ষিত ২০১০) এর তথ্যে শুধু গ্রীফন প্রজাতির শকুনই মাঝে মাঝে দেখা যায়। বাংলাদেশে ৬ প্রজাতির শকুনের দেখা পাওয়া যেত বলে যতদুর সম্ভব জানা গেছে। শকুন, রাজ শকুন, সাদা গিদরী বা গিন্নী শকুন, লম্বা ঠোঁট শকুন আমাদের দেশীয় প্রজাতি। আর ভ্রমণকারী হিসেবে কালো শকুন আর গ্রিফন শকুন ছিল।
বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে এক সময়ে গরু, মহিষসহ গবাধি পশুর মৃত দেহ যেখানে নিয়ে ফেলা হতো সেখানে দলে দলে হাজির হতো শকুন। দ্রæত গতিতে তারা মৃত গবাধি পশুর মাংস খেয়ে সাবাড় করে দিত। মৃত দেহের রোগ জীবানু শকুনের পেটে দ্রæত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে শকুনই প্রকৃতি হতে মৃত দেহ সরানোর কাজ করে রোগব্যাধী মুক্ত পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ফলে স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ থাকতো। গবাধি পশুর মৃত দেহের রোগ জীবানু মরে না। এগুলো সংক্রমিত হয়। শকুন এগুলো খেয়ে ফেললে রোগ বিস্তার রোধ হতো। কিন্তু এখন আর আগের মতো শকুন দেখা যায় না।
সারা পৃথিবী জুড়ে শকুনের অবস্থা খুবই নাজুক। পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়াজনীয় পাখি শকুন। কিন্তু গবেষকরা জানিয়েছেন পৃথিবীতে প্রায় ৯০ ভাগ শকুন আর নেই। এজন্যই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি অ্যানথ্রাক্স, য²া, ক্যান্সার, পানি বাহিতসহ বিভিন্ন রোগ ব্যাধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) এর ক্রিটিক্যালি এন্ডেনজার্ড এর তালিকায় রয়েছে শকুনের সব ক’টি প্রজাতি। কিন্তু বিগত ৩ দশকে বাংলাদেশে প্রায় ৯৯ ভাগ শকুন মারা গেছে। অবশিষ্ট এক ভাগও এখন মৃত্যু মুখে পতিত হচ্ছে। গবাধি পশু চিকিৎসায় ‘ডাইক্লোফেনাক’ দেয়া গরু, মহিষ, ছাগল মারা গেলে ওই মৃত দেহ খেয়ে শকুনের কিডনী নষ্ট হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মারা যায়। ফলে গত ৩ যুগে বাংলা শকুনের পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমে গেছে।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, শকুন না থাকার কারনে বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্স, যক্ষা, ক্ষোরা রোগ ইত্যাদি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার এবং জলাত্মঙ্ক রোগ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। শকুন না থাকায় গবাধি পশুর মৃত দেহ এখন শিয়াল, কুকুর, ইঁদুর, কাক, চিল সহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী খাচ্ছে। এদের পেটে রোগ জীবানু নষ্ট না হওয়ায় জংগল ও জনপদে পড়ছে এসব মারাত্মক ব্যাধি।
শকুন বিলুপ্ত হওয়ার আরো বড় একটি কারণ বাসস্থানের অভাব। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা প্রাচীন বৃহদাকার বৃক্ষরাজিতে বসতি গড়তো শকুন। শিমুল, ছাতিম, দেবদারুর মত প্রাচীনতম বৃহদাকার গাছগুলো এখন আর চোখে পড়ে না। এই ধরণের বড় ও উচুঁ গাছগুলিতে শকুন বাসা বাঁধে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বর্তমানে শকুনের বসতি তৈরী ও বিশ্রাম নেয়ার মতো বড় গাছ প্রায় নেই বললেই চলে। সরকারি বন, অন্যান্য বনাঞ্চল ও গ্রাম গঞ্জের বড় গাছের পরিমাণ একই হারে হ্রাস পেয়েছে। বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম জেপস বেঙ্গালেনসিস (Gyps bengalensis) । গলা লম্বা, লোমহীন মাথা ও গলা গাঢ় ধূসর। পশ্চাদেশের পালক সাদা। পা কালো। ডানা, পিঠ ও লেজ কালচে বাদামি। একই বাসা টিকটাক করে বছরের পর বছর ব্যবহার করে। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তাদের প্রজননকাল। ৪৫-৫০ দিনে ডিম ফোটে। এদেশে বেশি দেখা যেত বলেই তাদের নামের শেষে বাংলা শব্দটি চলে এসেছে।
বাংলাদেশে বাংলা শকুন এখন বিরল প্রজাতি। বর্তমানে এরা মহাবিপন্ন। দিন দিন এদের খাবার একেবারেই কমে এসেছে। যে কয়েকটি শকুন আছে তাদের বেশির ভাগ সুন্দরবন এলাকায় এবং কয়েকটি দল শ্রীমঙ্গলের কালাছড়া ও হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গা এলাকায় রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ দেশ শকুন শুন্য হয়ে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। তবে আশার কথা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শকুন সংরক্ষণ গুরুত্ব পেয়েছে। স¤প্রতি সময়ে বাংলাদেশেও শকুন নিয়ে সচেতনতা ও গবেষণাধর্মী কাজকর্মে ফলে পূর্বের অবস্থা থেকে কিছুটাও উন্নতি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বেশ কিছুদিন যাবত সিলেট ও খুলনা অঞ্চলে দু’টি সেইভ জুন স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ভাষা মনিটরিং, এক্টিভিটিস, বাচ্চার ফিডিং ষ্টেশন সহ শকুন সুরক্ষায় বিভিন্ন ধরণের গবেষনা কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে।
গবেষকরা শকুনের বিলুপ্তির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন গবাধি পশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দু’টো ঔষধের প্রভাব মৃত গবাধি পশুর দেহেও থাকে। এ ঔষধ প্রয়োগ করা হয়েছে এমন কোন মৃতদেহ শকুনের খাদ্য তালিকায় চলে এলে শকুনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আইইউসিএন-এর সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন উল্লেখ করেছে, কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সঙ্কট, কবিরাজি ঔষধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সাথে সংঘর্ষ, ঘুড়ির সুতার সাথে জড়িয়ে পড়া, ইউরিক এসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি কারণে শকুন বিলুপ্ত হচ্ছে। শকুন পরিবেশের জন্য খুবই উপকারী পাখি। অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়া, খুরা রোগ, গবাধি পশুর য²া, কলেরার জীবানু খুব সহজেই শকুন হজম করতে সক্ষম।
সময়োপযোগী আর পরিকল্পিত পদক্ষেপ না নিলে ‘বাংলা শকুন’ বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভারত, পাকিস্তান, নেপালে বেশ আগেই ‘ডাইক্লোফেনাক’ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও স¤প্রতি সময়ে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হলেও কেটোপ্রোফেন এর ব্যবহার মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। পর্যাপ্ত তদারকি না থাকায় ওই সব ঔষধ উৎপাদন ও মাঠ পর্যায়ে ব্যবহার প্রায় আগের মতোই রয়ে গেছে। ফলে কাঙ্খিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 999 বার