Daily Jalalabadi

  সিলেট     শনিবার, ১৬ই নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ১লা অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিভেদের নেপথ্য গল্প

admin

প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৩ | ১১:৩১ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিভেদের নেপথ্য গল্প

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক:
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস যদি ইসরাইলের সাধারণ জনগণের ওপর আক্রমণ করে থাকে, তাহলে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য অবশ্যই দোষারোপ করা যেতে পারে। অবশ্য তাদের এমন আচরণের একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এগুলো যদিও তাদের কর্মকাণ্ডকে ন্যায়সংগত দাবি করে না, কিন্তু এই প্রেক্ষাপটগুলো তাদের এমন আক্রমণাত্মক আচরণের সঞ্চালক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

এক দশক আগেও ইসরাইলের আগ্রাসী আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষ জেরুজালেমের রাস্তায় বিচ্ছিন্ন হামলা চালাত। ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড জেনেও বিভিন্ন জায়গায় ইহুদিদের হত্যা করত। এসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তখন তারা কোনো বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’—এমন ব্যানারে কোনো আন্দোলনও হয়নি। এমনকি তাদের এমন আচরণের পেছনে কোনো সংগঠনের উসকানিও ছিল না। অর্থাত্, হিংসাত্মক হতাশায় প্ররোচিত হয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে এ ধরনের হামলা চালানোর চেষ্টা করে থাকতে পারে।

পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে মোড় নেয়, যখন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অতি-ডানপন্থি, সম্প্রসারণবাদী দলগুলোর সঙ্গে মিত্রতা করে একটা নতুন সরকার গঠন করে, যারা প্রকাশ্যে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো দখল করে ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত করার পক্ষে ছিল। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বলেছিলেন, ‘আমার, আমার স্ত্রী এবং আমার বাচ্চাদের স্বাধীনভাবে পশ্চিম তীরে ঘুরে বেড়ানোর অধিকার আরবদের সেখানে ঘোরার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ উল্লেখ্য, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যাকে উগ্রপন্থি আরববিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে এর আগে সেনাবাহিনী থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই আরববিরোধী দলকে ১৯৯৪ সালে হেবরনে আরবদের গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে গর্ব করার পর নেতানিয়াহুর বর্তমান সরকারের অধীনে ইসরাইল একটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের ‘মৌলিক নীতির’ তালিকায় বলা হয়েছে, ‘বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের ইহুদি জনগণের ইসরাইলের ভূমির সমস্ত অংশে একচেটিয়া ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার রয়েছে।’ তারা এমনও ঘোষণা করেছে, ইসরাইলের সরকার গ্যালিলি, নেগেভ, গোলান, জুডিয়া ও সামারিয়ায় ইহুদি বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইসরাইল সরকারের এ ধরনের অবাস্তব প্রতিশ্রুতির মুখে ইসরাইলের সঙ্গে আলোচনা করতে অস্বীকার করার জন্য ফিলিস্তিনিদের তিরস্কার করা অযৌক্তিক। ইসরাইলের বর্তমান সরকারের নিজস্ব কার্যকলাপ ফিলিস্তিনের সঙ্গে আলোচনার দ্বার বন্ধ করে দিয়েছে, বলা যায়।

কিছু ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিক জোর দিয়ে বলেন, নেতানিয়াহুর সরকার নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিল, গাজায় ইসরাইলের নজরদারি এবং গোয়েন্দা বাহিনীর অতিরিক্ত আনাগোনার কারণে হামাস যে কোনো সময় আক্রমণ করে বসতে পারে। তবে হামাস কর্তৃক এই হামলা এখন ইসরাইলি কট্টরপন্থিদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, যারা দাবি করত নেতানিয়াহু ইসরাইলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম নয়।

যাই হোক না কেন, এটা সহজেই অনুমান করা যায়, উভয় পক্ষই তথা হামাস ও ইসরাইলের উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনায় বসতে রাজি নয়। উভয়েই একে অপরের মৃত্যুর জন্য লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

হামাসের হামলা এমন এক সময়ে ঘটল, যখন ইসরাইলের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহু সরকারের বিচার বিভাগকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টার কারণে তুমুল সংঘাত চলছে। বর্তমানে ইসরাইলের জনগণ জাতীয়তাবাদী মৌলবাদীদের মধ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে—এক দল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্ছেদ করতে চায়, অন্য দল গণতন্ত্র বিলুপ্তির এই হুমকি সম্পর্কে সচেতন, কিন্তু মধ্যপন্থি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে মিত্রতা করতে অনিচ্ছুক।

এই মুহূর্তে ইসরাইলে ক্রমবর্ধমান সাংবিধানিক সংকট স্থগিত করা হয়েছে এবং একটা জাতীয় ঐক্যের সরকার ঘোষণা করা হয়েছে। এমন ঘটনা সাধারণত সব দেশেই ঘটে থাকে। বাহ্যিক সংকটের উপস্থিতিতে সব দেশেরই অভ্যন্তরীণ বিভাজন সাময়িকভাবে স্তিমিত হয়ে যায়। অভ্যন্তরীণ শান্তি ও ঐক্য অর্জনের জন্য কি বহিরাগত শত্রু থাকতেই হবে? এই দুষ্টচক্র ভাঙার কি কোনো উপায় আছে?

ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট উল্লেখ করেছেন, এই মুহূর্তে সবচেয়ে কার্যকর পথ হলো হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের কাছেও পৌঁছানো, যারা ইহুদিবিরোধী নয় এবং আলোচনার জন্য প্রস্তুত। ইসরাইলের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা অস্বীকার করলেও আমি মনে করি, ফিলিস্তিনে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষের লোকজনের অস্তিত্ব রয়েছে। সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখে শতাধিক ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন এবং সবাই একমত হয়েছেন যে, ইহুদীবিদ্বেষী মনোভাবের মাধ্যমে অথবা ইহুদীবিদ্বেষকে ভুলভাবে উপস্থাপণ করার মাধ্যমে কখনোই দুই পক্ষের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

আমরা যখন বুঝতে পারব যে ইসরাইলের সব জনগণ ধর্মান্ধ ও জাতীয়তাবাদী নয় এবং ফিলিস্তিনের সব জনগণ ধর্মান্ধ ও ইহুদিবিরোধী নয়, তখনই হয়তো হতাশা ও বিভ্রান্তি কাটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলোচনায় দ্বার খোলা সম্ভব হবে। ফিলিস্তিনি ও ইহুদিদের মধ্যে একধরনের অদ্ভুত মিল রয়েছে। ফিলিস্তিনিরা যেমন তাদের নিজ জন্মভূমিতে পরাধীন, ইহুদিরাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একই অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিল।

‘সন্ত্রাসবাদ’ শব্দটির ক্ষেত্রেও অনুরূপ উপমা প্রযোজ্য। ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ইহুদিদের সংগ্রামের সময় ‘সন্ত্রাসী’ শব্দের একটা ইতিবাচক অর্থ ছিল। ১৯৪০-এর দশকের শেষের দিকে আমেরিকান সংবাদপত্রগুলো ‘ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের চিঠি’ শিরোনামে একটা বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিল, যেখানে হলিউড চিত্রনাট্যকার বেন হেচ ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘আমার সাহসী বন্ধুরা, আমি আপনাদের যা লিখছি তা হয়তো আপনারা বিশ্বাস করতে পারবেন না। কারণ এই মুহূর্তে অনেক ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, আমেরিকার ইহুদিরা আপনাদের সঙ্গে আছে।’

এই মুহূর্তে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে কাকে সন্ত্রাসী হিসেবে গণ্য করা যায়, তা পরিষ্কারভাবে বলা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনি জনগণের বিরাট একটা অংশ কয়েক দশক ধরে অস্থিরতার মধ্যে বসবাস করছে। তারা কারা এবং তাদের দেশ কোথায়? তারা কি ‘অধিকৃত অঞ্চল’, ‘পশ্চিম তীর’, ‘জুডিয়া ও সামারিয়া’ অঞ্চলের বাসিন্দা; নাকি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বাসিন্দা, যা ১৩৯টা দেশ দ্বারা স্বীকৃত এবং ২০১২ সাল থেকে জাতিসংঘের অস্থায়ী পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে? তবু ইসরাইল ফিলিস্তিনের প্রকৃত ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে এবং ফিলিস্তিনিদের অস্থায়ী বসতি স্থাপনকারী হিসেবে বিবেচনা করে। তারা ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের একমাত্র প্রকৃত আদিবাসী হিসেবে একটা ‘স্বাভাবিক’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাধা হিসেবে বিবেচনা করে। তারা ফিলিস্তিনিদের একটা সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে। ইসরাইল রাষ্ট্র কখনোই ফিলিস্তিনিদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। তারা যে স্থানে বাস করে, সেখানে কখনোই তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়নি।

হামাস ও ইসরাইলি কট্টরপন্থিরা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। এর মধ্যে একটা দলকে বাছাই করে নেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাত্, ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি চরমপন্থিদের মধ্যে আপস সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনিদের অবশ্যই তাদের অধিকারের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষার সঙ্গে লড়াই করতে হবে এবং একই সঙ্গে যারা ইহুদীবিদ্বেষী মনোভাব পোষণ করে, তাদেরও শক্তভাবে দমন করতে হবে।

শুনতে অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু ইসরাইল-হামাস দুই পক্ষের লড়াই মূলত একই ধাঁচের। সাধারণ জনগণের ওপর হামলার বিরুদ্ধে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে আমরা নিঃশর্তভাবে সমর্থন করতে পারি—করা উচিতও; কিন্তু গাজা ও ইসরাইল অধিকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনিরা যে মরিয়া ও আশাহীন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে, তার প্রতিও আমাদের নিঃশর্ত সহানুভূতিশীল হতে হবে।

লেখক: দ্য ইউরোপিয়ান গ্র্যাজুয়েট স্কুলের দর্শনের অধ্যাপক ও লন্ডন ইউনিভার্সিটির বার্কবেক ইনস্টিটিউটের আন্তর্জাতিক পরিচালক

দ্য খালিজ টাইমস থেকে অনুবাদ: আবদুল্লাহ আল মামুন

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার

শেয়ার করুন