Daily Jalalabadi

  সিলেট     সোমবার, ১৮ই নভেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হত্যাকান্ড, অপমৃত্যু আর বিশেষ বিয়ে নিয়ে ব্যস্থ ছিলেন বিয়ানীবাজারবাসী

admin

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৪:৫৩ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩ | ০৪:৫৩ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
হত্যাকান্ড, অপমৃত্যু আর বিশেষ বিয়ে নিয়ে ব্যস্থ ছিলেন বিয়ানীবাজারবাসী

মিলাদ জয়নুল:
‘আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়। মোছ আঁখি, দুয়ার খোলো, দাও বিদায়।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ গানের সুর ধরেই যেন বিদায়ের বার্তা নিয়ে নতুনের আবাহনে বিলীন হচ্ছে ২০২৩। নতুন আলোর প্রত্যয়ে সপ্তাহদিন পরেই বিশ্ববাসী স্বাগত জানাবে খ্রিষ্ট্রিয় ২০২৪ সাল।

বিদায় মানেই আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। বিদায়ের মুহুর্তে চোখের দৃশ্যপটে একটি বছর যেন অতীত-ইতিহাস। বিদায়ী এই বছরটি কেমন কাটিয়েছেন বিয়ানীবাজারবাসী, তা নিয়েই আমাদের এ প্রতিবেদন।

২০২৩ সালে বিয়ানীবাজারে একাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। একইসাথে বেশ কয়েকটি অপমৃত্যুর ঘটনাও বিয়ানীবাজারবাসীর হৃদয় নাড়িয়ে দেয়। তবে বছরের শেষ সময়কাল অর্থাৎ নভেম্বর থেকে জাতীয় নির্বাচনের দামামা বেজে ওঠায় রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। এখনো সেই নির্বাচনের ঢামাঢোল বাজছে বেশ জোরেশোরে।

জানা যায়, চলতি বছরের ১৯ আগস্ট জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে বিয়ানীবাজার উপজেলার মুড়িয়া ইউনিয়নের তাজপুর গ্রামে আপন ভাই ও তার সহযোগীদের হামলায় নিহত হন প্রবাসী জালাল উদ্দিন। এ ঘটনায় নিহতের মেয়ে ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী জোবায়দা জালাল সিলেটের আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে আদালতের নির্দেশে বিয়ানীবাজার থানায় মামলা রেকর্ড করা হলে পুলিশ তার লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্তের জন্য প্রেরণ করে। মামলায় নিহতের বড় ভাই সুনাম উদ্দিন (৬০), তার দ্বিতীয় স্ত্রী রাবিয়া বেগম (৩৬), পালিত কন্যা মান্না বেগম (২২) ও একই এলাকার পাথারিপাড়া গ্রামের আব্দুল হাছিব (৪৫) কে আসামী করা হয়েছে।

বিদায় নিতে যাওয়া বছরে উপজেলা থেকে বিপুল সংখ্যক লোক কানাডা, ইটালীসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশী গেছেন আইইএলটিএস উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা। উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপ, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে স্টুডেন্ট ভিসায় পাড়ি জমানোর ঢল ছিল বছরজুড়ে। সঙ্গে স্বামী বা স্ত্রীকে স্পাউস ভিসায় নিয়ে যাওয়ার সুযোগকেও কাজে লাগিয়েছেন তাঁরা। উচ্চশিক্ষা ছাড়াও আইইএলটিএস পাস করে কেয়ার ভিসায় যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান অনেকে। এতে খরচ হয় প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা। এই ব্যয় সুরাহা করতে কেউ কেউ কন্ট্রাক্টে, আবার অনেকে সত্যিকারের বিয়ে করছেন। বিয়ের সময় কনে কিংবা ছেলে পক্ষের কাছ থেকে খরচের সমুদয় টাকা নেওয়া হচ্ছে।

গত ১০ সেপ্টেম্বর মোল্লাপুর ইউনিয়নের কাছাটুল গ্রামে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়। মারা যাওয়া শিশু আব্দুল্লাহ তাওছিফ (৬) কাছাটুল গ্রামের কূয়েত প্রবাসী গৌছ উদ্দিনের ছেলে এবং নুরা (৫) কাতার প্রবাসী ছালিক আহমেদের মেয়ে। আব্দুল্লাহ তাওছিফ ও নুরা পরষ্পর চাচাতো ভাই বোন ।

গত ১২ জুলাই কুড়ারবাজার ইউনিয়নের খসিরবন্দ-কইরবন্দ এলাকায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন গৃহবধূ ফাহমিদা বেগম (২২)। তিনি উপজেলার মেওয়া গ্রামের জমির উদ্দিনের ছেলে এবং আবিদুর রহমানের স্ত্রী। মঙ্গলবার দিবাগত রাত আনুমানিক ৩টার সময় স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হয় স্বামী আবিদের। এরপর তিনি রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে স্ত্রী ফাহমিদা ঘরের দরজা লাগিয়ে দেন। এর ঘণ্টা খানেক পর আনুমানিক রাত ৪ টার সময় ডাকাডাকি করার পরও স্ত্রী দরজা না খোলায় দরজা ভেঙ্গে দেখেন স্ত্রী ফাহমিদা ফ্যানের রডের সাথে ঝুলে আছেন। এ ঘটনায় থানায় অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়।

 

গত ২৯ জুন একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে পরকীয়া প্রেমিককে কুপিয়ে আত্মহত্যা করেন এক যুবতী। ওই প্রেমিকের কর্মস্হলের অফিস কক্ষে প্রবেশ করে আচমকা কুপিয়ে ঘটনাস্থলেই গলায় দড়ি পেচিয়ে আত্মহনন করেন তিনি। উপজেলার কুড়ার বাজার ইউনিয়নের খশিরবন্দ কমিউনিটি ক্লিনিকে এ ঘটনা ঘটে। আত্মহননকারী মরিয়ম বেগম মরি (৩৫)’র লাশ উদ্ধার করে পুলিশ সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করে। মোবাইল ফোনে কথা কাটাকাটির জের ধরে যুবতী মরিয়ম বটি দা নিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিকের আশপাশে পূর্ব থেকে অপেক্ষা করতে থাকেন। স্বাস্থ্য কর্মী গোপাল দাস অফিসে প্রবেশ করার পরই আচমকা তার উপর হামলা চালান মরিয়ম। তিনি খশির রামনগর গ্রামের মনির আলীর মেয়ে।

 

এদিকে মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় প্রাণ হারায় কিশোর আয়মান (১৫)। সে দক্ষিণ মুড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। তার বাড়ি উপজেলার মুড়িয়া ইউনিয়নের কোনাগ্রামে।

 

গত মে মাসে উপজেলার আঙ্গারজুর গ্রামের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এমদাদ হোসেন টিপুর লাশ পাওয়া যায়। নিখোঁজের ৯ দিন পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরেন স্বজনরা। ২৭ মে থেকে সে নিখোঁজ ছিল।

 

গত ২ জুন কুড়ারবাজার ইউনিয়নের আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর এলাকায় জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের আঘাতে একজনের মৃত্যু হয়। সিলেট-বিয়ানীবাজার সড়কের পাশে আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর-গাছতলা সড়কের কাছে এ ঘটনা ঘটে। প্রতিবেশি এবং আপন ফুফাতো ভাই আব্দুল ওয়াহিদ গংদের সাথে দীর্ঘদিন থেকে জমি নিয়ে জয়নুল ইসলামের বিরোধ ছিল।

 

এদিকে মুড়িয়া ইউনিয়নের নওয়া গ্রাম সীমান্ত এলাকার চাতল পাড় থেকে এক ব্যক্তির গলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। বিয়ানীবাজার থানা পুলিশের একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে অজ্ঞাত এই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে।

 

গত ৪ মে বিয়ানীবাজার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্বশীলদের অবহেলায় এক নবজাতকের মৃত্যু নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তার স্বজনরা। প্রসবের সময় স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মনে করে অভিভাবকরা লাশ বাড়ি নিয়ে দাফনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। একপর্যায়ে অভিভাবকরা দেখতে পান নবজাতকের দেহ থেকে মাথা অনেকটা বিচ্ছিন্ন। মুহূর্তে বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকাবাসী হাসপাতাল ঘেরাও করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। জানা যায়, বিয়ানীবাজার উপজেলার কুড়ারবাজার ইউনিয়নের বৈরাগীবাজার গড়রবন্দ এলাকার আইসক্রিম বিক্রেতা অহিদুর রহমান তার স্ত্রী প্রসুতি রহিমা বেগমকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। বিকালে প্রসব ব্যথা উঠলে প্রসূতি মাকে লেবার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। দায়িত্বশীল দুই নার্সের সঙ্গে একজন চিকিৎসকের সহায়তায় মৃত নবজাতকের জন্ম হয়।

 

গত ১২ এপ্রিল আলীনগরে প্রবাসীর স্ত্রী স্বপ্না বেগম হত্যার অভিযোগে আপন ভাসুরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শফিক উদ্দিন (৬০) নামের ওই ব্যক্তির ছুরিকাঘাতে স্বপ্নার মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। গ্রেফতার ব্যক্তি উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের পূর্ব খলাগ্রাম এলাকার মৃত ইব্রাহিম আলীর ছেলে। মার্চ মাসে পৌরশহরের কলেজ রোডে একটি নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হন। এ সময় অপর আরেকজন গুরুতর আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শী ও ভবনের মালিকপক্ষের লোকজন বিদ্যুৎপৃষ্ট দুই নির্মাণ শ্রমিককে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেরণ করলে সেখানে মাহফুজ আহমদ নামের ওই শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

 

 

কেমন ছিল ২০২৩, এমন প্রশ্নের জবাবে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান জামাল হোসেন জানান, দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে শান্ত জনপদ ছিল বিয়ানীবাজার। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ছিলনা বললেই চলে। প্রেসক্লাব সভাপতি সজীব ভট্রাচার্য বলেন, প্রকৃতপক্ষে বিয়ানীবাজারবাসী বছরটি কাটান সৌহার্দ-সম্প্রীতির আবরনে। সবার লক্ষ ছিল এই জনপদকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আসলে জন্মমাটির প্রতি এ ধরনের টান থাকা উচিত।

 

বিয়ানীবাজার পঞ্চখন্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলী আহমদ বলেন, রাজনীতি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে লালন করে ভালো দিন কাটিয়েছেন উপজেলার মানুষ। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটলেও এখানে সবাই ছিলেন একে অপরের আপনজন।

এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 994 বার

শেয়ার করুন