কানাইঘাট সংবাদদাতা:
সিলেটের কানাইঘাট উপজেলায় গত তিন সপ্তাহে বিভিন্ন ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একের পর এক এই অস্বাভাবিক মৃত্যুতে পুরো কানাইঘাট উপজেলায় শোকের ছায়া নেমে আসার পাশাপাশি জনমনে ভয় ও আতংকের সৃষ্টি করেছে। একই ঘটনায় তিন জন নিহত হওয়ার ঘটনায় জনমনে চাপা ক্ষোভও বিরাজ করছে।
মসজিদের সীমানা নিয়ে বিরোধে সংঘর্ষে আপন তিন ভাই নিহত হন। এই তিন জনের মৃত্যুতে দুশ্চিন্তায় একই পরিবারের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় একজন, বিদ্যুৎস্পৃষ্টে একজন এবং পানিতে ডুবে ১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বন্দুকধারীর গুলিতে কানাইঘাটের ইউসুফ নামের একজন নিহত হন এ সময়ে।
ট্রিপল মার্ডারসহ একই পরিবারের চার জনের মৃত্যু :
উপজেলার বড়চতুল ইউনিয়নের হারাতৈল মাঝবড়াই গ্রামের জামে মসজিদের সীমানার জায়গা নিয়ে বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষে আপন ভাই-ভাতিজাদের হাতে তিন ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনাটি সিলেটজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে। এই ঘটনায় দুশ্চিন্তায় একই পরিবারের রুমানা নামের এক পুত্রবধূর মৃত্যু হয় ।
গত ২২ এপ্রিল সকাল ১১টায় নিহতদের আপন বড় ভাই সমছুল হক ও ভাতিজা আলমাছ উদ্দিন, কামাল আহমদ, সুহেল আহমদ, রুহুল আহমদসহ অন্যান্যরা দেশীয় ধারালো অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে অতর্কিত হামলা চালায়। ধারালো লম্বা দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জয়নাল আবেদীনকে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। চিৎকার শুনে বাড়ি থেকে ভাইকে প্রাণে বাঁচাতে এগিয়ে এলে হামলাকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জয়নাল আবেদীনের আপন বড় ভাই দুবাই প্রবাসী ছয়ফুল্লাহ ও ওমান প্রবাসী আব্দুল্লাহসহ আরও দুই জনকে গুরুতর আহত করে। সংঘর্ষের দিন সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে মারা যান সাবেক ইউপি সদস্য জয়নাল আবেদীন। একই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৮ এপ্রিল মারা যান বড় ভাই ছয়ফুল্লাহ এবং সিলেট ইবনেসিনা হাসপাতালের আইসিউতে থাকা ভাই আব্দুল্লাহ গত ২ মে মারা যান।
কানাইঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ জাহাঙ্গীর হোসেন সরদার বলেন, ‘মসজিদের সীমানার জায়গা নিয়ে সংঘর্ষে ভাতিজাদের হাতে পর পর মারা যাওয়া তিন ভাইয়ের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের প্রত্যেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পাচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ’
এ ব্যাপারে কানাইঘাট গণশিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ.ডি গবেষক এহসানুল হক জসীম বলেন, ‘প্রায় পাঁচ দশক আগে চতুল এলাকায় একই পরিবারের তিন ভাই নিহত হয়েছিলেন। ২০২৪ সালে এসে একই পরিবারের তিন ভাইয়ের মৃত্যুতে আমরা হতবাক। দোষীদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে হবে।’
বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু :
মসজিদে নামাজ পড়াতে যাওয়ার সময় বজ্রপাতে কবীর উদ্দিন (৩৫) নামের এক ইমামের মৃত্যু হয়। তিনি উপজেলার বড়চতুল সোনাতলা এলাকার এবাদুর রহমানের ছেলে। গত ২১ এপ্রিল ভোর চারটার দিকে জৈন্তাপুর উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ হাওর এলাকায় বজ্রাঘাতে এই ঘটনা ঘটে।
গত ২ মে বোরো ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে এক কৃষক নিহত হন। এই ঘটনায় গুরুতর আহত হন আরো দুই জন। উপজেলার দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের শফিক হাওরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত কৃষক বাবুল আহমদ (৪৮) উপজেলার দক্ষিণ কুয়রেরমাটি এলাকার মৃত আব্দুস সালামের পুত্র।
মাঠে গরু চরাতে গিয়ে বজ্রপাতে এক ওমান প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার দর্পনগর পশ্চিম করচটি গ্রামের রফিকুল হকের পুত্র ওমান প্রবাসী মোহাম্মদ মাহতাব উদ্দিন উরফে মাতাই। স্থানীয়রা জানান, গত ৬মে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নিহত মাহতাব উদ্দিন সুরমা নদী তীরবর্তী মাঠে গরু চরাতে যান। এক পর্যায়ে হঠাৎ বজ্রপাত হলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে যুবকের মৃত্যু:
গত ২ মে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হেলাল আহমদ নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। নিহত যুবক পৌরসভার লালারচক গ্রামের আব্দুছ ছালামের ছেলে।
পৃথক ঘটনায় ফুফু-ভাইজির মৃত্যু:
গত ৪ মে একইদিনে পৃথক ঘটনায় ফুফু ও ভাইজির মৃত্যু হয়েছে। উপজেলার দিঘীরপার পুর্ব ইউনিয়নে এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, দিঘীরপার ইউনিয়নের মাঝরগ্রামের হাফিজ আব্দুল আহাদের তিন বছর বয়সী মেয়ে বাড়ির সকলের অজান্তে পানিতে ডুবে মারা যায়। ভাতিজির মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে মেয়েটির ফুফু দিঘীরপার পুর্ব ইউনিয়নের দর্পনগর পশ্চিম (নয়াগ্রাম) আব্দুস শহীদের স্ত্রী রুকিয়া বেগম (৩০) বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে সড়কের বাজার এলাকায় টমটম উল্টে রুকিয়া বেগমসহ তিন জন আহত হন। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজন তাদেরকে উদ্ধার করে সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর বিকেলে রুকিয়া বেগম মারা যান।
এ ছাড়া গত ২৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের বাফেলো শহরে কৃষ্ণাঙ্গ দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন ইউসুফ আলী জনি (৪২)। তিনি কানাইঘাট উপজলোর ঝিঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের তিনচটি গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য নুরুল হকের ছেলে।
এত কম সময়ের ব্যবধানে এতো অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে ভয় ও আতংক বিরাজ করছে।
এ ব্যাপারে এহসানুল হক জসীম বলেন, ‘কানাইঘাট উপজেলায় এতো কম সময়ে এত সময়ে এমন সংখ্যক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় স্মরণাতীতকালে ঘটেনি।’ নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন,‘ তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।’
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার