বিয়ানীবাজার সংবাদদাতা:
বিয়ানীবাজারের চারখাই উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশীদ-কে পদত্যাগের হুমকি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগের প্রতিবাদ জানিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ভুক্তভোগী শিক্ষক আব্দুর রশীদ।
আজ সোমবার সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদ দাবি করেন, আদালতের মামলা নিষ্পত্তি পরবর্তী এডহক কমিটির আওতায় ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একটা বিশেষ মহল বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্রের আশ্রয়ে নেয়া ভিত্তিহীন অভিযোগ আমলে না নেওয়ার জন্য তিনি সকল সংবাদকর্মী, সুশীলসমাজ ও সংশ্লিষ্টদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
জানা যায়, ঐতিহ্যবাহী চারখাই উচ্চ বিদ্যালয়ে আব্দুর রশিদ ১৯ জুলাই ১৯৯৩ সনে সহকারী শিক্ষক (গণিত) পদে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুল কাদির ২০১৭ সনে অবসরে গেলে ম্যানেজিং কমিটি মৌখিকভাবে গণিত শিক্ষক আব্দুর রশিদ-কে একাডেমিক দায়িত্ব ও শ্রেণিকার্যক্রম তদারকির অনুরোধ করেন। সেই সময় থেকে তিনি বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োগপূর্ব (সহকারী প্রধান শিক্ষক) অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে বিগত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ইং তারিখে তিনি বিধি মোতাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
১৩ জুন, ২০২২ইং তারিখে অত্র প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক স্বপ্না রাণী দত্ত পুরকায়স্থ অবসরে গেলে সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশীদ ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের আগেই ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আদালতে মামলা গড়ায়। অবসরপ্রাপ্ত বিদায়ী প্রধান শিক্ষকের আমলে ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন সংক্রান্ত একটি মামলা বিজ্ঞ আদালতে চলমান থাকাবস্থায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনে হিমসিম খেতে হয়েছে। ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ (১৮ জুলাই ২০২২ইং পর্যন্ত) উত্তীর্ণ হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সভাপতি বিহীন কমিটির সদস্যবৃন্দকে নিয়ে মামলা সংক্রান্ত খরচাদি ও বিদ্যালয়ের যাবতীয় ব্যয়ভার পরিচালনা করেন। আদালতের মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কমিটিবিহীন সময়কালে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশিক নূর বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা উত্তোলন বিলে প্রতিস্বাক্ষর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর তিন মাস শিক্ষক-কর্মচারীগন আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হন।
প্রশ্ন: প্রধান শিক্ষকের চলতি দায়িত্বে আসার পর থেকে বিল-ভাউচার জালিয়াতির মাধ্যমে স্কুলটিকে দুর্নীতি ও দাপটের রাজত্বে পরিণত করার অভিযোগ উঠেছে আপনার বিরুদ্ধে। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কি?
আব্দুর রশীদ : আমি তো ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক পদের শূন্যতায় আমি চলতি দায়িত্বে আছি। কমিটিবিহীন দায়িত্বভার গ্রহণ থেকে এডহক কমিটির সময়কাল আমাকে একাই সামলাতে হয়েছে। একদিকে মামলা সংক্রান্ত খরচাদি, অন্যদিকে শিক্ষক-কর্মচারীগন বেতন না পাওয়ার ভোগান্তিতে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থ থেকে আনুষঙ্গিক খরচ ও শিক্ষক-কর্মচারীদেরকে ঋণ দিয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা করতে হয়েছে। পরবর্তীতে মামলা নিষ্পত্তি হলে এতদসংক্রান্ত কাগজাদি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে সিলেট শিক্ষাবোর্ডে প্রেরণ করা হলে বোর্ড কতৃপক্ষ এডহক কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেন। ১২ অক্টোবর ২০২২ইং তারিখে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফসানা তাসলিমকে সভাপতি করে এডহক কমিটি (৬ মাস) গঠিত হয়।
২০২২ সনের জুন, জুলাই স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় বিয়ানীবাজারসহ সিলেটের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ ছিল। ফলে কমিটিবিহীন সময়কাল ২০২২ এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর, এডহক কমিটির অক্টোবর/২২ থেকে মে/২৩ পর্যন্ত মোট দশ মাসের বিল-ভাউচার বাবত সর্বসাকুল্যে ১৬ লক্ষ ৮১ হাজার ৭০৪ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ দশ মাসের খরচে স্কুল বেতন বাবত ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৫০২ টাকা, প্রভিডেন্ট ব্যয় বাবত ৪ লাখ ১৩ হাজার ৭৩৩ টাকা ও খরচের ভাউচার বাবত ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬৯ টাকা রয়েছে। এসবের ফাইল প্রতিবেদন তৎকালীন ইউএনও’র কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করিলে তিনি তাঁর অফিসের মুদ্রাক্ষরিক তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী ও মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মৌলুদুর রহমান কে বিল-ভাউচার যাচাই-বাছাইকরণের দায়িত্ব দেন। জমাকৃত এ দশ মাসের খরচের মাস ওয়ারি পৃথক পৃথক টপশীট ও মাসিক প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই শেষে নির্দেশনাসহ ফাইলগুলো জমা হয়। পরবর্তীক্রমে ইউএনও আফসানা তাসলিম হঠাৎ বদলি হয়ে অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ায় বকেয়া বিল-ভাউচার অননুমোদিত রয়ে যায়।
প্রশ্ন: আপনার (ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক) বিরুদ্ধে ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন সদস্য অভিযোগ তুলেছেন, আপনি না-কি দাপট ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে বিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি ও হুমকি-ধামকিসহ নানা অনিয়মের সাথে লিপ্ত রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য কি?
আব্দুর রশিদ : এমন প্রশ্নে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘স্থানীয় একটি কুচক্রী মহল আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে জড়িয়ে বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে বিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে বিভিন্ন দপ্তর এবং সাংবাদিকদের দিয়ে অভিযোগ ছড়াচ্ছে। এসব অভিযোগ আদৌ সত্য নয়। মূলতঃ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে কেউ কেউ আমার বিরুদ্ধে মনগড়া তথ্য দিয়ে আমাকে অযথা হয়রানি করা হচ্ছে।’
প্রশ্ন: এডহক কমিটি থাকাকালীন আয়-ব্যয়ের হিসাবে গড়মিল থাকায় না-কি তৎকালিন সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফসানা তাসলিম কতৃক খরচাদি অনুমোদিত হয়নি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
আব্দুর রশিদ : এ প্রসঙ্গে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জানান, বিদ্যালয়ের মাসিক খরচাদি রুটিন-মাফিক কাজ। বিল-ভাউচার বিদ্যালয়ের একটা চলমান প্রক্রিয়া। নথিপত্রে লেখালেখির অনিয়ম থাকতে পারে। ত্রুটি থাকতে পারে। এরজন্য কতৃপক্ষ নির্দেশনা দিবেন। কিন্তু এখানে অর্থ আত্মসাতের মতো মনগড়া প্রশ্ন উঠবে কেন? তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার অন্যত্র স্থানান্তর হওয়ায় বিল স্বাক্ষরিত হয়নি, এটি সত্য। বিল ভাউচার সঠিকভাবেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। চলমান কমিটি তা যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন করে নিতেই পারে। এটা নিয়ে ভুয়া অজুহাতে তিলকে তাল বানানোর পায়তারা শুভ নয়।
প্রশ্ন: দশম শ্রেণীর প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষার খাতা দেখার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কি বলবেন?
আব্দুর রশিদ : ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, শিক্ষাক্রম নিয়ে যারা জানে খণ্ডিত, তাদের অভিযোগও হয় বিকৃত। দীর্ঘ ৩০ বছরের শিক্ষকতা শেষে এমন অভিযোগ শুনতে হবে, তা ভাবতেই অবাক লাগে। এসব পুরোপুরি ভিত্তিহীন। পত্রিকায় ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’ আর থানার এজহারে ‘অজ্ঞাতনামা আসামি’- এসব শব্দ চয়ন জনমনে বিভ্রান্তি ও শংকা বাড়ায়। এসব অভিযোগ পাঠকদের জন্য মুখরোচক উপজীব্য বিষয়।
প্রশ্ন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলন চলাকালীন (২০ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সেই সময়ে সন্দেহজনক টাকা বিল-ভাউচারের দেখানোর অভিযোগ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আপনার ব্যাখ্যা কি?
আব্দুর রশিদ : প্রাতিষ্ঠানিক কাজের খরচ সন্দেহজনক নয়। আর এ সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধের কোন পরিপত্র কতৃপক্ষ থেকে আসেনি। উল্লেখিত সময়ে স্কুল প্রদত্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জুলাই/২৪ মাসের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে এবং ২২ জনের আপ্যায়ন খরচ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
প্রশ্ন: বিগত ১৪ জুলাই ম্যানেজিং কমিটির সভার ৬নং সিদ্ধান্ত প্রস্তাব মোতাবেক নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ ও নিয়োগ পরীক্ষায় প্রধান শিক্ষক পদে উত্তীর্ণ শামসুল ইসলামকে অজ্ঞাত কারণে বিদ্যালয়ে যোগদান করতে দেন নি। এ অভিযোগ কতটুকু সত্য?
আব্দুর রশিদ: এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। তিনি জানান, ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচিত প্রধান শিক্ষকের স্কুল প্রদত্ত মাসিক সম্মানি বাবত ১৫ হাজার টাকা ধার্য্য করে দেন। কিন্তু নির্বাচিত প্রধান শিক্ষক এর বিপরীতে ২০ হাজার টাকা মাসিক সম্মানি দাবি করে বসেন। এই সম্মানির দর কষাকষির পর অধুনা বিলুপ্ত সভাপতি মাহমদ আলী দাবিকৃত টাকা প্রদানে সম্মত হয়ে ৫ আগস্ট ২০২৪ইং তারিখের মধ্যে যোগদানের লক্ষ্যে যথাযথভাবে নিয়োগপত্র দিলেও তিনি যোগদান করেন নি। যেখানে কমিটির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, সেখানে আমার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কষ্টের বিষয়। আমি বাঁধা দেইনি, বরং উনিকে যোগদানের জন্য উৎসাহিত করেছি।
প্রশ্ন: ডিজিটাল প্রজেক্টর বিক্রির অভিযোগ কি সত্য?
আব্দুর রশিদ : এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা ডাহা মিথ্যা অপবাদ। স্টক রেজিস্ট্রার অনুযায়ী দু’টি প্রজেক্টের মধ্যে একটা প্রজেক্টের নষ্ট ; এটি মেরামতের জন্য বিদ্যালয়ের আইসিটি শিক্ষক ওয়ালী উল্লাহ’র পরামর্শে মেরামতে (মেরামত স্লিপসহ) দেয়া হয়েছে।
এই সংবাদটি পড়া হয়েছে : 1K বার